নিঃশব্দ আর্তনাদ by সুভাষ সাহা

শুক্রবার উদ্ধার হওয়া দুটি নরকঙ্কাল মানব মগজের ভয়-জাগানিয়া টিস্যুগুলোতে আতঙ্কের সংকেত পাঠানো শুরু করেছে। ফলে বুকের ভেতরের থরহরিকম্প নিঃশব্দ আর্তনাদের মতো মনের ইথারে চড়ে আমাদের চারপাশ, এই চরাচরকে যেন ঘিরে ধরছে।


এমনিতেই মাঝে মধ্যে হত্যা-গুমের খবর সমাজে এক ধরনের মানসিক উত্তেজনা, বৈকল্যের জন্ম দিয়ে চলেছে অলক্ষ্যে। এভাবে চলতে থাকলে গোটা সমাজই এক সময় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। একটা সময় আসতে পারে, যখন মানুষ তার ছায়াকে দেখেও মৃত্যুভয়ে আচমকা আঁতকে উঠবে। হয়তো এই দুটি লাশের পরিচয় মিলবে বা মিলবে না। কিন্তু এতে মানবমনে সৃষ্ট আতঙ্ক সহজে দূর হওয়ার নয়। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শ্রমিক নেতা, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, নারী গুম-খুনের নিশানায়। সামান্য নেশার টাকার জন্য পর্যন্ত আপন পিতা-মাতাকে খুন করতে সন্তানের হাত কাঁপে না। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কোনো ডাকাত দল, সন্ত্রাসী মারা পড়লে আমাদের সমাজ তাকে বাহবা দিতে ভোলে না। আমাদের মধ্যবিত্ত অন্যের নিদানের বিনিময়ে হলেও নিজের সুখ-শান্তিকে উপভোগ করতে চায়। এভাবেই একটা সময়ে হত্যা-গুম এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যায় আমাদের সমাজে। কিন্তু এর বিস্তার যখন মধ্যবিত্তের কল্পিত শান্তির দেয়ালকে ভেঙে চুরমার করে সেখানেও আস্তানা গাড়তে উদ্যত হয়, তখনই শুরু হয় হায়-হায় রব। এভাবেই নাগরিক অধিকারকে মানুষ নিজেরাই সংকুচিত করায় আশকারা দেয় না! বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারী শাসকরা, নাৎসিরা, বিভিন্ন কাল্ট, মাফিয়া ডনরা, ড্রাগ ব্যারনরা মানুষ হত্যার হোলি খেলায় মত্ত হতো এবং এখনও হচ্ছে। তা তো আমরা মিডিয়ার কল্যাণে অবগত হই। আবার সমাজে অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে ব্যক্তি বা ছোট ছোট গ্রুপও হত্যা-গুমে জড়িয়ে পড়তে পারে। যে তরুণ অস্ত্র আর রক্ত দেখলেই শিউরে উঠত, এক সময় তার চোখে সহসা অস্ত্র ও রক্ত নেশা ধরায়। আধুনিক গণতন্ত্রের নেতৃস্থানীয়রা পর্যন্ত এই তরিকাটি ভিন্নরূপে এস্তেমাল করছে অবলীলায়।
যারা মারছে আর যারা মরছে তারা কেউ কি সামাজিক জীব নয়! তাদের কি ঘর-সংসার থাকে না! তাই এ ধরনের খুন-গুমের বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া এড়ানো যায় না। আধুনিক রাষ্ট্র এখন কোথাও কোথাও ক্রিমিনালদের ধরা ও ঠেঙানোর পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদেরও হেনস্তা করতে দ্বিধা করে না। এ ধরনের প্রবণতার শিকার কোনো ভিনদেশি সাবেক সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত হতে পারেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি আবুল কালামকে মার্কিন বিমানবন্দরে হেনস্তা করার ঘটনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ লোপ পায়। এমনকি একটি সম্প্র্রদায় অপর সম্প্রদায়কে শক্র ভেবে মনের কোণে ঘৃণা পর্যন্ত পোষণ করতে পারে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন উপলক্ষে এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ও হত্যার ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ।
একদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার, অন্যদিকে মানুষের অধিকার তথা বিভিন্ন উপায়ে গণতন্ত্রের সংকোচন, আয়-বৈষম্য তথা শ্রেণী-বৈষম্য মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি, অর্থবান-ক্ষমতাবানদের দাপট বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে শুধু আমাদের দেশ নয়, গোটা বিশ্বে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মীর হাত কখনও কখনও আততায়ীর হাতে পরিণত হচ্ছে। হয়তো কোনো কোনো বিদগ্ধ জন এটাকে পুঁজিবাদী সংকট সৃষ্ট সামাজিক অবক্ষয়ের মূর্ত প্রকাশ বলে দায়িত্ব সারতে পারেন। কিন্তু সমাজের গভীরে সৃষ্ট ক্ষতের এতে কি উপশম হয়! আর হয় না বলেই সমাজে মানসিক বৈকল্যের বিস্তার ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালে মানসিক রোগ বিশ্বের বৃহত্তম অসুখে পরিণত হওয়ার হিসাব কষে ভুল করেনি। এই গুম-খুনের তমসা থেকে আমাদের মুক্ত হতেই হবে। তবে এর জন্য সব মানুষের, সব শ্রেণীর মানুষের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার এবং নাগরিক অধিকারকে সবার স্বীকার করে নিতে হবে। অপরের অধিকারের বিনিময়ে নিজের অধিকারের সুরক্ষা নয়; সবার অধিকারের মধ্যেই আপন অধিকারকে আবিষ্কার করতে শিখতে হবে। তাহলেই নিঃশব্দ আর্তনাদ থেকে মুক্তি মিলবে।
 

No comments

Powered by Blogger.