অপসংস্কৃতি-কত্তো বড় ক by ওয়াসি আহমেদ

গবেট ছাত্রকে লেখাপড়ায় সামান্যতম আগ্রহী করতে ব্যর্থ হয়ে হতাশ শিক্ষক মনের ঝাল মিটিয়েছিলেন এই বলে যে গাধা ছাত্রটি এতই গাধা, ক অক্ষরটি লেখার যোগ্যতাও তার নেই। এহেন তিরস্কার বেচারা ছাত্রের বড়ই মর্মপীড়ার কারণ হয়েছিল। ক অক্ষরটি যে সে লিখতে জানে, এ নিয়ে তার অন্তত কোনো সন্দেহ ছিল না।


তাই প্রমাণস্বরূপ পরীক্ষার উত্তরপত্রে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে সে শুধু ক-ই লিখে চলে। পৃষ্ঠাপ্রতি একেকটা বিশাল ক। নিজের সার্থকতায় পুলক প্রকাশ করতে প্রতিটি ক-এর নিচে লিখে রাখে: কত্তো বড় ক!
আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটাকে যত লঘু মনে হচ্ছে, বাস্তবে মোটেও তা নয়। খেয়াল করলে বোঝা যাবে, ছাত্রটি শুধু ক লিখেই ক্ষান্ত হয়নি। সে যে যাচ্ছেতাই ফেলনা নয়, তার প্রমাণ দিতে কত বড় ক সে লিখতে পারে, সে চেষ্টাই করেছে। উত্তরপত্রের প্রতি পৃষ্ঠায় একেকটা প্রকাণ্ড ক লিখে সে আসলে নিজেকেই উপস্থাপন করেছে। এখানে ক অক্ষরমাত্র নয়, ক সে নিজে।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ক-এর প্রাদুর্ভাব এত দূর ছড়িয়েছে রাস্তাঘাটে মানুষের দৃষ্টিকে চাবুকপেটা করে হলেও ক-এর বাহার দেখানো চাই। ডানে-বাঁয়ে তাকান, সামনে তাকান, রোড আইল্যান্ডে তাকান, ক আপনাকে রেহাই দেবে না। আর তারা তো শোভা পাচ্ছে বিশালাকার পোস্টারে, টানা লম্বা ফেস্টুনে, ডিজিটাল বিলবোর্ডে। বিশাল সব ক, কী সৌষ্ঠব, কী রং-বাহার! রাজধানী ঢাকার কথা ছেড়ে দিলাম, জেলা-উপজেলা শহরেও ক-দের উদাত্ত, আকর্ণবিস্তৃত দৌরাত্ম্য। আকর্ণ এ জন্য যে এই ক-দের কান আছে। আবার নাক, ঠোঁট, গাল, কপাল, হুবহু মানুষের যা যা থাকার কথা সবই আছে। তফাত এখানে, এই ক-দের আপনার-আমার দৃষ্টিপথে টাঙিয়েছে ক-রা নিজেরাই। নিজেদের রূপবৈভবে এই ক-রা এতই বিভোর, মায়াবী, ঢুলুঢুলু চোখে তারা আপনার পথ আটকে ‘আমাকে দেখো, আমাকে দেখো’ কিংবা ‘আমি কে দেখো’ বলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, সেই সঙ্গে আপনাকে বিমূঢ় করে দিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে, কত উঁচু দরের মানুষের সঙ্গে তাদের ওঠাবসা! উঁচু বলতে উঁচু, একদম পাহাড়চূড়ায় তাদের অবাধ যাতায়াত। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে আপনি খেয়াল করবেন রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ এক নম্বর ব্যক্তিকে নিয়েই তাদের কাজকারবার। এক নম্বর ছাড়া অন্য কাউকে তোয়াক্কা করা দূরের, শুভেচ্ছা বিনিময় পর্যন্ত তারা করে না। দুই, তিন, চার নম্বর নিয়ে তাদের মাথায় এতটুকু ব্যথা-বেদনা নেই। তারা খোদ প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানায়। দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক তাবৎ কর্মকাণ্ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যকে অকাতর চিত্তে অভিনন্দিত করে। বঙ্গোপসাগরে দেশের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সাফল্যে যেমন অভিনন্দিত করে, তেমনি গলাচিপায় আমন ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্যও করে, আবার দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক তারকা সাকিব আল হাসানের লংঅন দিয়ে পর পর দুটো ছক্কা হাঁকানোর জন্যও করে।
কিন্তু হাজার হাজার বা লাখ লাখ ক-দের ভিড়ে নিজেদের বৈশিষ্ট্যময় করাও তো দরকার। না হলে খোদ এক নম্বর জানবেন কী করে কোন ক তাঁকে কী ভাষায় (বানান-টানান ভুল হোক, দীর্ঘ ইকারের শ্রদ্ধাঞ্জলির শ্রদ্ধা বাড়ে বৈ কমে না) শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানিয়েছে! তাই ক-দের মধ্যে কে কতটা চওড়া-চ্যাপ্টা, কার নাক-গাল কতটা রংদার, কার কপাল কতটা নিভাঁজ-মসৃণ এবং মূল বিষয়টা—কার দৃষ্টি কতটা কাতরতাপ্রবণ বা বোভাইন লুকসমৃদ্ধ এসব গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিনাটি হাজির করতে একটা প্রতিযোগিতার ব্যাপার এসেই যায়। ক-দের তাই খুব সংগত কারণেই নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
এখন প্রশ্ন, এক নম্বরকে শুভেচ্ছা, স্বাগতম, অভিনন্দন ইত্যাদি জানাতে গিয়ে গাঁটের এত্তো এত্তো টাকাকড়ি দেদার ঢেলে ক-দের ফায়দাটা কোথায়? গর্ধবের পক্ষেই এমন প্রশ্ন মানায়। খারাপ লোকেরা বলে, মানুষ স্বার্থপর প্রাণী, স্বার্থবিনা এক পা-ও তার চলে না। কিন্তু এখানে স্বার্থ কোথায়; এক নম্বরের সাফল্য, কৃতিত্বকে অকুণ্ঠ সম্মান জানানো ছাড়া এখানে কোনো কুগন্ধের আলামত খোঁজা দুষ্কৃতি ছাড়া কিছু নয়। তবে তাদের জেল্লাদার চেহারা-সুরত আপনার ঈর্ষার কারণ হতে পারে। কোরবানির হাটে সদ্য সিং-গজানো তেল-পিচ্ছিল গা-গতর ও তুলতুলে গলকম্বলধারী ষাঁড়দের সঙ্গেই একমাত্র তুলনা চলতে পারে। ষাঁড়দের মোটা-তাজা করা হয় মূলত ইউরিয়া খাইয়ে। ক-দের কী খাওয়ানো হয় বা ওরা নিজেরাই কী খায়? হতে কি পারে যে, খাওয়া-খাদ্যের বিষয়টা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। ক-রা কি গরু যে ইউরিয়া বা পটাসিয়াম সুপার ফসফেট খাবে! কিছুতেই ওরা গরু নয়। গরুর শিং থাকে, পা দুটোর জায়গায় চারটা, আবার লেজও থাকে যা মুচড়ে ধরলে শোয়া থেকে এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়, দাঁড়ানো থাকলে ছুটতে পথ পায় না। ক-দের এসব কোনোটাই নেই। সুতরাং চেহারায় যত সাদৃশ্যই থাকুক—বিশেষত ঢুলুঢুলু ডাগর চোখের—গরু ওরা নয়ই নয়।
গরুর চামড়া কত কাজে লাগে, ক-দের রেশম-কোমল চামড়া কী কী কাজে লাগানো সম্ভব, তা কি মোটেও ভাবার বিষয় নয়? আপনি ভাবতে পারেন গাল-গলায় মোলায়েম চামড়ায় মিহি রুমালের কথা—পান খেয়ে ঠোঁট মুছবেন বা দস্তনা—শীতে কবজিতে আঙুলে আরাম পাবেন, আর...। আপনার কল্পনার দৌড় হয়তো এ পর্যন্তই। কারণ, পোস্টারে বিলবোর্ডে ক-দের চেহারার চেকনাই-ই শুধু দেখতে পান। কিন্তু একবার ভাবুন চোখ-মুখ ছাড়িয়ে বুক-পেট-পিঠের অতি উন্নত টেক্সচার-সমৃদ্ধ চামড়ার কথা। কী বানাবেন, মানে কী হতে পারে? ব্যাগ, থলের কথা অনায়াসে ভাবা যেতে পারে, কিংবা তাকিয়া বালিশের খোল। অন্য অনেক কিছুর কথাও ভাবতে পারেন। সারা দেশের শহরাঞ্চলে দুঃসহ ট্রাফিক জ্যাম, যানবাহনের চেয়ে হাঁটাই উত্তম, আর প্রচুর হাঁটাহাঁটিতে পায়ের কষ্ট লাঘব করতে আপনি এক জোড়া খুব আরামদায়ক—হ্যাঁ, পাদুকার কথা ভাবতেই পারেন।
ক-দের নিয়ে যা-ই ভাবুন, ওদের ঈর্ষা করবেন না। ওদের থাকতে দিন ওদের জায়গায়—ল্যাম্পপোস্টে, রোড আইল্যান্ডে, সদ্য চুনকাম করা আপনার বাড়ির দেয়ালে, তাগড়াই গাছের কাণ্ডে, বাস-ট্রেনের গায়ে, ফুটব্রিজে, ফ্লাইওভারে, হাইওয়ের দুই পাশে মজবুত লোহার ফ্রেমে, পাবলিক টয়লেট, যাত্রী ছাউনিতে। আপনার দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করে হলেও থাকুক। বলা তো যায় না, ভবিষ্যতে কপালগুণে এক নম্বর যদি হয়ে যান, ওরা আপনাকে মুহুর্মুহু শুভেচ্ছা, স্বাগতম, অভিনন্দন জানাতে মরিয়া হয়ে উঠবে।
নিঃস্বার্থ ক-দের খাসলত-ই এই।
ওয়াসি আহমেদ: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.