যুগ্ম সচিব হয়েও ২২ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক-পদ না থাকলেও পদোন্নতি, প্রশাসনে সমস্যা বেড়েছে by মোশতাক আহমেদ

অপরিকল্পিত পদোন্নতিতে জনপ্রশাসনে সমস্যা বেড়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত ৬৪৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু উচ্চতর পদ না থাকায় তাঁদের অধিকাংশই এখনো আগের পদেই রয়ে গেছেন।
এ ছাড়া পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনার যে উদ্যোগ সরকার নিতে চেয়েছিল, সেটাও এখন আর হচ্ছে না।


সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ ব্যবস্থা হিসেবে নিচের পদে থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা কত দিন চলবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এতে করে পদোন্নতি পেয়েও কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা এবং জেলা প্রশাসনে এ অবস্থা বিরাজ করছে। জেলা প্রশাসকেরা উপসচিব মর্যাদার। ২৫ জন জেলা প্রশাসক পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ২২ জন এখনো জেলা প্রশাসকের আগের দায়িত্বেই রয়েছেন। এতে তাঁরা হতাশ। আবার উপসচিব পর্যায়ের ওই সব পদে নতুন করে যাঁদের নিয়োগ পাওয়ার কথা, তাঁরাও তা পাচ্ছেন না। ফলে তাঁদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
প্রশাসনের এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসকের পদটি উপসচিব মর্যাদার। এই পদে যুগ্ম সচিবদের রাখা সঠিক হচ্ছে না। এই পদে যুগ্ম সচিবেরা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই উপসচিবদের মধ্যে যাঁরা যোগ্য, তাঁরা জেলা প্রশাসক হতে পারবেন না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান সিকদার জানান, জেলা প্রশাসক পদে থাকা যুগ্ম সচিবদের পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসা হবে। তবে এখনই নয়।
যাঁরা পদোন্নতি পাননি, তাঁদের আবেদন পর্যালোচনা করার আশ্বাস দেওয়া হলেও সে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যেও হতাশা বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসনে স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
৮ ফেব্রুয়ারির পদোন্নতির ফলে ১২৭ জন অতিরিক্ত সচিব, ২৬৪ জন যুগ্ম সচিব ও ২৫৮ জন উপসচিব হন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একসঙ্গে এটাই সবচেয়ে বড় পদোন্নতি। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই পদের চেয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বেশি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যাপ্ত পদ না থাকায় পদোন্নতির পর সিংহভাগ কর্মকর্তাকেই আগের জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে একেক মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব রয়ে গেছেন। পরে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পদগুলোর পুনর্বিন্যাস করা হয়। আগে উপসচিবেরা যে পদে দায়িত্ব পালন করতেন, সেটাকে এখন উপসচিব/যুগ্ম সচিব হিসেবে বলা হচ্ছে। আর যুগ্ম সচিব পদের বেলায় করা হয়েছে যুগ্ম সচিব/ অতিরিক্ত সচিব।
পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার কথা বলা হলেও অচিরেই এ সমস্যা কাটছে না। কারণ, অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর ফলে ওপরের পদে থাকা কর্মকর্তারা আগামী পৌনে দুই বছরে অবসরে যাচ্ছেন না। তাই পদোন্নতি পেয়েও নিচের পদেই থাকতে হবে। এটা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে। জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে দূরত্বও বাড়ছে।
আশাহত বঞ্চিত কর্মকর্তারা: পদোন্নতিবঞ্চিত অনেক কর্মকর্তা আশা করেছিলেন, সরকারের আশ্বাস অনুযায়ী পর্যালোচনার মাধ্যমে তাঁদের পদোন্নতি হবে। এ জন্য পদোন্নতির পর প্রায় ৫০০ কর্মকর্তা আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পর্যালোচনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্যালোচনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।
পদোন্নতি না পাওয়া একজন উপসচিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক ও আর্থিক সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। হতাশায় কাজ করতে উৎসাহ পাই না। অফিসে গিয়ে যখন দেখি, আমার একই ব্যাচের কর্মকর্তার কক্ষের সামনে যুগ্ম সচিবের নামফলক ঝুলছে, তখন নিজেকে ছোট মনে হয়। বেশি খারাপ লাগে যখন দেখি, বিসিএস পরীক্ষায় আমার চেয়ে অনেক নিচে থাকা কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন।’
পদোন্নতি না পাওয়া একজন যুগ্ম সচিব বলেন, পদোন্নতি হওয়া উচিত পদ ও মেধার ভিত্তিতে। কিন্তু এখন পদোন্নতি হয় দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও এ রকম হয়েছে। এসব কারণে মেধাবীরা প্রশাসন ক্যাডারের চাকরিতে উৎসাহ পান না।
পর্যালোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুস সোবহান সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত আর পর্যালোচনা হচ্ছে না। তবে পরে যখন পদোন্নতি দেওয়া হবে, তখন তাঁদের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে।
এ বিষয়ে আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের বিষয়টি পর্যালোচনা করা উচিত। নইলে হতাশা বাড়বে, কাজের পরিবেশ নষ্ট হবে।

No comments

Powered by Blogger.