শ্রমিকের অধিকার-শোভন কাজের নিশ্চয়তা চাই by ওয়াজেদুল ইসলাম খান

মহান মে দিবস প্রতিবছর শ্রমজীবী মানুষের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নততর জীবনযাপনের প্রত্যয় নিয়ে আসে। শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছে এ দিনটি বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। মে দিবস শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে শ্রমজীবী মানুষকে উজ্জীবিত করার অনুপ্রেরণা জোগায়।
কিন্তু একদিকে বিশ্বায়নের প্রভাব ও অন্যদিকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপত্র অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মতো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ফলে শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা, শোষণ ও নিপীড়ন। বিশ্বায়নের নামে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সোশ্যাল ক্লজে শ্রমিকদের অধিকার ও তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি বা ন্যায্য পাওনার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভিনব কায়দায় আজ নতুন নতুন পন্থায় শোষণের বেড়াজালে শ্রমিকেরা আবদ্ধ। শ্রমিক-কর্মচারীরা আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ (যা আমাদের দেশের সরকার অনুসমর্থিত করেছে) অনুযায়ী তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। শতাধিক বছর আগে যে আট ঘণ্টা কর্মদিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আজ ভূলুণ্ঠিত। আট ঘণ্টার পরিবর্তে কোনো ওভারটাইম ছাড়াই কাজ করানো হচ্ছে দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা। উন্নয়নশীল দেশ যেখানে সার্বিকভাবে কর্মদিবসের ঘণ্টা কমিয়ে আনছে, সেখানে আমাদের দেশে প্রচলিত শ্রম আইনকে উপেক্ষা করার কারণে শ্রমঘণ্টা মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। এমনকি ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও দেওয়া হচ্ছে না। গার্মেন্টস, ট্যানারিসহ বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এমনকি বর্তমানে অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে প্রকৃতপক্ষে চাকরির নিশ্চয়তা বা চাকরি শেষে ভবিষ্যতে কী হবে তার কোনো নিরাপত্তার বিধান নেই। অসংগঠিত খাতগুলোয় বেশির ভাগ শিল্পে শ্রমিকদের নেই কোনো নিয়োগপত্র, নেই প্রচলিত ছুটি ও ভাতা এবং অধিকার। চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণসহ তাদের ওপর চলছে সাঁড়াশি আক্রমণ। শ্রমজীবী মানুষ আজ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
এর পাশাপাশি আমরা লক্ষ করছি, শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের জন্য শোভন কাজের (ডিসেন্ট ওয়ার্ক) দাবি আজ বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়েছে। মহান মে দিবসে শ্রমিকেরা বিশ্বব্যাপী বিজয় এবং সংহতি দিবস পালন করে আসছে। অথচ আমাদের দেশের শ্রমিক ঠিক উল্টো অবস্থানে দিন যাপন করছে। বিজয় তো দূরের কথা, বরং শ্রমিকেরা যে অধিকারটুকু পেয়েছিল তাও আজ বিলীন হতে চলেছে। শ্রমিকেরা অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার এবং আইএল কনভেনশন ৮৭-এর ভিত্তিতে পছন্দমতো নেতা নির্বাচন এবং অবাধে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তোলা থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থায় শোভন কাজ বা কর্মক্ষেত্র না থাকায় শ্রমিক-মেহনতি মানুষ তার মৌলিক ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং উপেক্ষিত হচ্ছে তার মানবাধিকার।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ব্যবস্থাপত্রে পরিচালিত সরকারসমূহের ভ্রান্ত নীতির ফলে রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পসমূহ আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের দোরগোড়ায়। ভারী ও ঐতিহ্যবাহী দেশীয় শিল্পসমূহ একের পর এক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশসমূহের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পরনির্ভরশীল করার মাধ্যমে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে গ্রাস ও কুক্ষিগত করে বিশ্ব মোড়ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। বিশ্বায়নের ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আমাদের মতো দেশে দেশীয় শিল্পপণ্য বিকাশের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে বিদেশি পণ্যের অবাধ বাজার। বিশ্বায়নের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশি শিল্প গড়ে তোলার নামে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের সস্তা শ্রম। পুঁজিবাদ, আন্তর্জাতিক করপোরেশন এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাদের বিপর্যয়কে রক্ষা করার জন্যই উদারীকরণ এবং বিশ্বায়নের মাধ্যমে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদকে মজবুত করতে চাইছে।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দুর্বল ও হেয় করার জন্য ক্রমাগত ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নই সব অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী বলে প্রচার করা হয়। অথচ আমরা জানি, ট্রেড ইউনিয়নকে সম্পৃক্ত এবং আস্থায় নেওয়ার মাধ্যমেই দেশে দেশে শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল। আমাদের দেশেও কিছু ট্রেড ইউনিয়ন আছে, যারা সঠিক ভূমিকা পালনের ফলে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের পাশাপাশি শিল্প বিকাশেও সমান ভূমিকা পালন করছে। তার নজির ট্যানারিশিল্প এলাকাসহ আমাদের দেশের বেশ কিছু শিল্পে পরিলক্ষিত। তবু আমাদের দেশের মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনকে সহ্য করতে পারে না। ইউনিয়নের প্রতি মালিকেরা সব সময় বিমাতাসুলভ আচরণ করে, ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে পুলিশ, পেটোয়া সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের দিয়ে শ্রমিকদের দমন করা হয়, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়, এমনকি কখনো কখনো শারীরিকভাবেও নির্যাতন করা হয়। শ্রমিকদের দমন করার জন্য মালিক মাস্তান বা সন্ত্রাসী পুষছে, এমনকি এসব মাস্তানকে শ্রমিকের ঘামঝরা শ্রমে উত্পাদিত পণ্যের একটি অংশ মাসিক মাসোহারা হিসেবে দিচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য পাওনা বা হিস্যা দেওয়া হয় না। আমরা জানি, এই মাস্তান, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজেরা সমাজকে কলুষিত করছে এবং তারা সামাজিক অব্যবস্থা ও নৈরাজ্যের জন্য দায়ী।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি বিশেষভাবে সরকারি দল বা কর্মকর্তাদের তোয়াজ করে তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীরা নামকাওয়াস্তে কিছু সুযোগ-সুবিধা পায়; বাস্তবে রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক-কর্মচারীদের সার্বিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। অতীত অভিজ্ঞতা এবং সর্ব সময়ের স্বীকৃত, ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া দাবি আদায়ের বিকল্প নেই। তোয়াজ বা তোষামোদ করে কোনো দাবিই আদায় হয় না। একইভাবে মালিক বা কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বুঝতে হবে, মাস্তান বা গুন্ডা দিয়ে নয়, শ্রমিকদের আস্থায় নিয়েই তাদের ন্যূনতম চাহিদা বা ন্যায্য দাবি পূরণের মাধ্যমে শিল্পের পরিবেশ ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং উত্পাদন বৃদ্ধি বা শিল্প বিকাশ সম্ভব।
বাস্তবতা এটাই প্রমাণ করছে, আমাদের মতো দেশের জন্য বিশ্বায়ন কোনো সমাধান নয়। বিশ্বায়ন দারিদ্র্য বিমোচনের পরিবর্তে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বয়ে আনে। বিশ্বায়নের দাবানল থেকে আমাদের মতো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ব্যক্তিমালিকানার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ত খাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারি নীতি পরিবর্তন করে শিল্প-শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পরনির্ভরশীলতা নয়, আত্মনির্ভর অর্থনীতিই দেশের উন্নয়ন ও বিকাশকে বেগবান করবে। এ লক্ষ্যে দেশের উন্নয়ন, বিকাশ, উত্পাদনশীলতা এবং শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থে সরকারের নীতি প্রণয়ন অপরিহার্য।
ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

No comments

Powered by Blogger.