দিল্লির চিঠি-ভারত-পাকিস্তান বিভেদের কবলে সার্ক by কুলদীপ নায়ার

গত সপ্তাহে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জনগণের সার্ক সম্মেলন ছিল সম্ভবত আরও এক নিষ্ফল অনুশীলন, প্রতিবন্ধকতার পাহাড় মাপার আরও এক চেষ্টা। তবু সেটির লক্ষ্য ছিল থিম্পুতে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের কাছে গুরুত্বের সঙ্গে এই বাণী পৌঁছে দেওয়া যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যত দিন পর্যন্ত উপলব্ধি করবে না যে পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া উপায় নেই, তত দিন পর্যন্ত তারা উন্নয়ন-অগ্রগতিতে পিছিয়েই থাকবে।


আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা—সার্কভুক্ত এই আটটি দেশ থেকে মানবাধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন, নারী সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা জড়ো হয়েছিলেন দিল্লিতে। তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর একটি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন, যেখানে প্রতিটি দেশের স্বতন্ত্র পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব অটুট থাকবে। কেউ কেউ এমনকি এক বাজার, এক ভিসা ও এক মুদ্রাব্যবস্থার সম্ভাবনার কথা বলেন। দুই দিনের সম্মেলন শেষে সব দেশের প্রতিনিধিরা (শুধু পাকিস্তান থেকেই এসেছিলেন ৬০ জন) তাঁদের যৌথ বিবৃতিতে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের এমন এক দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনরুচ্চারণ করেন, যে দক্ষিণ এশিয়া হবে সব ধরনের বৈষম্য, বিযুক্তি ও আধিপত্য থেকে মুক্ত।
এগুলো যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী আদর্শ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব আদর্শ অর্জনের চেষ্টা করা অবশ্যই যায়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা এসব আদর্শের ব্যাপারে শুধু নিজেদের প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তা-ই নয়, দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়নের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে তাঁরা জাতীয়তাবাদ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তাঁদের বক্তৃতায় কোনো বিদ্বেষ ছিল না, ছিল না কোনো তিক্ততা বা কোনো অভিযোগ। তাঁরা পরস্পরের মনের কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন, বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী হিসেবে একত্রে বসবাস করার পন্থাগুলো নিয়ে তাঁরা কথা বলেছেন।
এই আটটি দেশের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধরনে আলাদা। আবার এক দিক থেকে তারা সবাই সবার মতো। বিদেশি শাসনের সময়গুলোতে তাদের মানস এমন এক সভ্যতার আদলে গড়ে উঠেছে, সেখানে কতগুলো অভিন্ন ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা তাদের মৌলিক সমাধান খোঁজে এলাকার ভেতর থেকে নয়, বরং বাইরে থেকে।
এই নির্ভরতা তাদের দাসত্বের পরিণাম। যে ব্রিটিশরা এই পুরো অঞ্চল শাসন করেছে, তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল নিষ্ঠুর প্রভুসুলভ। তারা তাদের সাম্রাজ্যের কাঠামো গড়ে তোলার কাজে এই অঞ্চলের মানুষকে ব্যবহার করেছিল ইট আর চুন-সুরকির মতো। যেকোনো বড় বা বেখাপ পাথর, যা তাদের কাঠামোতে খাপ খায়নি, তারা তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে বা সরিয়ে ফেলেছে। তাদের সেই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে বেশি লোক উঠে দাঁড়ায়নি; অল্পসংখ্যক যারা দাঁড়িয়েছিল, তাদের শুরুতেই দমন করা হয়েছে। অন্যদের করা হয়েছে নিশ্চিহ্ন।
তবু এখানকার বিভিন্ন জাতিগত ঐতিহ্যের মানুষ ব্রিটিশ শাসকদের পরাজিত করেছে, মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বিদায় নিতে বাধ্য করেছে। স্বাধীনতার পথে যাত্রায় তারা কখনো হোঁচট খেয়ে পড়েছে, কখনো উঠে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছেছে। দুঃখ-দুর্দশা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার সেসব কাহিনি আজও স্মরণ করা হয়।
প্রতিটি শৃঙ্খলিত দেশ নিগ্রহ-অপমান থেকে যে শিক্ষা পায়, দক্ষিণ এশিয়াও তা পেয়েছে। কিন্তু যে শিক্ষাটি দক্ষিণ এশিয়া পায়নি তা হলো, সমস্যা উত্তরণের জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। ঐক্যবদ্ধ হলেই কেবল তারা বুঝতে পারে কোন পথে এগোতে হবে, কী কৌশলে এগোতে হবে, কী ধরনের মিত্রের সন্ধান করতে হবে। এই সবকিছুর জন্য প্রয়োজন হয় এই বোঝাপড়ার যে তারা ঐক্যবদ্ধ, তাদের বিভেদের ফাঁক নেই। এটা অনুমানের বিষয় নয়; পারস্পরিক মতামত বোঝার একটা উপায় বাতলাতে হয়।
জনগণ কী ভাবে, উন্নয়নের সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের অনুভূতি কী—এসব বোঝার চেষ্টা করার মধ্য দিয়েই জবাবদিহির বীজ রোপিত হয়। যদি কাউকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হয়, তাহলে যারা জবাবদিহি চায় তাদের কিছু করার ক্ষমতা থাকতে হয়। কারা হবে এ ধরনের মানুষ? সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের জনসাধারণ বিশ্বের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে প্রতিপক্ষদের হটিয়ে, বিশেষত রাজাকে হটিয়ে। সেই থেকে জনগণের সার্বভৌমত্ব হয়ে ওঠে সভ্য জনগণের সরকারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফ্রান্সের মতো কিছু জাতি ইংল্যান্ড থেকে এই দৃষ্টান্ত গ্রহণ করেছিল।
আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ পর্যবেক্ষণশীল। বিদেশি শাসন উচ্ছেদ করতে আমরা দৃঢ়সংকল্প ছিলাম। স্বশাসন প্রতিষ্ঠার উপায়ও আমরা খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় ছিল শুধু তা-ই, যা ব্রিটিশরা আমাদের শিখিয়েছিল—নানা ধরনের আইন, যেসবের অধীনে সতর্কভাবে বাছাই করা কিছু লোক এসে পার্লামেন্টে জড়ো হয়ে শাসন করবে। খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ আসত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে। এটাই ছিল আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে আমাদের সংগ্রাম ছিল ক্রমশ অধিক সংখ্যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব অর্জন করা।
আমরা স্বাধীন হলাম, তবু পরস্পরের রক্ত ঝরালাম অনেক। ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হলো ধর্মের ভিত্তিতে। শ্রীলঙ্কা আর ভুটানকে স্বাধীনতা দেওয়া হলো কেবল তখনই, যখন তারা আর ব্রিটিশ প্রটেকটরেট থাকল না। সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে যখন সংবিধান রচনা করা হয়, তখন জনগণের মতামত স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পায়। সংবিধানের মধ্য দিয়ে পাওয়া সবচেয়ে বড় অর্জনটি ছিল জনগণের অধিকারগুলোর প্রাধান্য এবং এই নিশ্চয়তা যে স্বাধীন দেশগুলোর মানুষেরা সাদা চামড়ার প্রভুদের জায়গায় খয়েরি চামড়ার সাহেবদের বসাবে না।
শুধু সরকারের প্রশ্ন নয়, একই সঙ্গে ছিল জনগণের সার্বভৌমত্বের সাংবিধানিক নিশ্চয়তাও। কীভাবে এই নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করা যাবে যে ভোটারদের অধিকার তাদের হাতেই থাকবে? এবং গণতন্ত্র মানে কি শুধুই ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের মধ্যেই হয়তো পাওয়া যাবে এই জিজ্ঞাসার উত্তর, দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র টিকে থাকবে কি না।
এই সময়ের মধ্যে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনা অনেকটাই পূরণ হতো যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধের অবসান ঘটানো যেত। বাস্তব সত্য হলো, শীর্ষ সম্মেলনে যদি দুই দেশ কোনো বিষয়ে একমত হয়ে চুক্তিও করে, তা সীমাবদ্ধ থেকে যায় কাগজে-কলমেই, কারণ উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ সেসব সিদ্ধান্ত আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে না।
স্বাধীনতার আগের সময়ের বিভেদগুলোও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভারত ও পাকিস্তান। এক দিক থেকে এটা সেই পুরোনো হিন্দু-মুসলমান মানসিকতাই। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সব চিন্তা সংকীর্ণতার দ্বারা নস্যাত্ হয়ে যায় যখন তার সামনে আসে পাকিস্তান। অন্যদিকে, পাকিস্তান কখনোই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করেনি, এমনকি ‘রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই’—কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই ঘোষণা দেওয়ার পরও।
১৯৪৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে অনেকবার: কাশ্মীর নিয়ে তারা যুদ্ধ করেছে; সর্বাত্মক যুদ্ধ হয়েছে দুবার ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে। এ ছাড়া সীমিত পরিসরে ও অপ্রকাশ্য যুদ্ধে তারা লিপ্ত হয়েছে অনেকবার। এখন উভয় দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্র আছে। তবু এখনো তারা পরস্পরকে শুধু ঘৃণাই করতে পছন্দ করে। কাশ্মীর বা পানি নিয়ে বিরোধ লক্ষণমাত্র, রোগ নয়। রোগটা হলো সন্দেহ, অবিশ্বাস, যা কোনো কোনো রূপে প্রকাশিত হয়। একটা সমস্যার সমাধান হতে পারে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কুিসত মাথা তুলবে আরেকটা সমস্যা। কারণ, মূল সমস্যা হিন্দু-মুসলমান বিভেদ রয়েই গেছে। এ দুই দেশ কী করে এ থেকে বেরিয়ে আসবে?—যত তাড়াতাড়ি আমরা এই প্রশ্নের উত্তর পাব, সার্ক ততই শক্তিশালী হবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.