এমপি গিয়াসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ-গফরগাঁওয়ে আরো অশান্তির আশঙ্কা by নিয়ামুল কবীর সজল

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের আলোচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ অনেক দিন ধরেই নিজ দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন। উপজেলা সদরে দিন দিন নড়বড়ে হচ্ছিল তাঁর অবস্থান। তবে নিজ এলাকা গফরগাঁওয়ের দক্ষিণাঞ্চলের ভোট আর জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি ছিলেন নিশ্চিন্ত।


কিন্তু কয়েক মাস আগে ঘোষিত পাগলা থানা নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলেরই একটি বড় অংশের মানুষের বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা তাঁকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তবে গত শুক্রবার স্থানীয় কান্দিপাড়া বাজারে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে এমপি গিয়াস উদ্দিন নিজেই নতুন জটিলতা ও অশান্ত পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছেন।
গতকাল রবিবার গফরগাঁও এলাকা ঘুরে সেখানকার রাজনীতি সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতির ত্রিমুখী ধারা, উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে এমপির বিরোধ, পাগলা থানা নিয়ে কয়েকটি এলাকার মানুষের ক্ষোভ- সব মিলিয়ে গফরগাঁওয়ের সার্বিক পরিস্থিতি এখন চরম অস্থির। স্থানীয় অনেকের মতে, সরকারের মেয়াদকাল যত কমে আসছে, ততই যেন এখানকার রাজনৈতিক নেতাদের অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। পেশিশক্তির মহড়া দেখাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাঁরা। স্থানীয় প্রশাসনও এদের আচরণে অসহায়। একের পর মামলা-পাল্টামামলাও হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে গফরগাঁওয়ে আরো বড় ধরনের অঘটনের আশঙ্কা করেছেন অনেকেই।
গফরগাঁওয়ের অনেকেই বলেছেন, এই এলাকায় যাঁরা এখন মূল নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের কাউকে নিয়েই সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বিশেষ বিশেষ নেতাদের প্রশ্রয়ে থাকে। অপকর্মের হোতাদের নেতারা আশ্রয় দেন। ভুক্তভোগীরা মামলা করতে গেলেও নেতারা পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করেন। পুলিশকে থানায় গিয়ে হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরাও অনেক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সুযোগ পেলেই হেনস্থা করেন। দোকানপাটে হামলা, প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষকে মারধর, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নানা ঘটনা গফরগাঁওয়ের নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুচ্ছ ঘটনায়, যখন তখন মোটরসাইকেল ও অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়া এখন সাধারণ দৃশ্য।
স্থানীয় অনেকের ভাষ্য, এমপি গিয়াস উদ্দিনের পায়ের তলা থেকে ক্রমশ মাটি সরে যাচ্ছে। অহংকার, ক্ষমতার অপব্যবহার, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া ও নানা দুর্নীতির অভিযোগে সাধারণ মানুষ তো রয়েছেই, দলেরও অনেক নেতা-কর্মীর শ্রদ্ধা আর আস্থা হারিয়েছেন তিনি।
উপজেলা পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে তিন গ্রুপের জন্ম : গত সংসদ নির্বাচনের পরপরই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গফরগাঁও আওয়ামী লীগে নতুন মেরুকরণ ঘটে। এমপি সমর্থন দেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা আলাল আহমেদকে। তিনি দলীয় প্রার্থী ছিলেন। আবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এলাকার সাবেক এমপি ও একসময়ের আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা প্রয়াত আলতাফ হোসেন গোলন্দাজের ছোট ছেলে ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল প্রার্থী হলে দৃশ্যপট বদলে যায়। একই সঙ্গে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় নির্বাচনে ভোটের হিসাবও এলোমেলো হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাবার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। গফরগাঁওয়ের রাজনীতি তখন বিভক্ত হয় দুই ভাগে। তৃতীয় ভাগের জন্ম হয় পৌর নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে এমপি সমর্থন করেন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মতিউর রহমান বাবুলকে। অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান সমর্থন করেন তরুণ ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন সুমনকে। আবার কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা কায়সার আহমেদ নিজেও প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। এবার গ্রুপের সংখ্যা দাঁড়ায় তিনটিতে। আওয়ামী লীগের এই তিন পক্ষই এখন এলাকায় সরব। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপির বিরোধ চরম পর্যায়ে।
একের পর এক অনভিপ্রেত ঘটনা : এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরোধের জের ধরে একের পর অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে গফরগাঁওয়ে। গত বছরের ৩১ মার্চ স্থানীয় ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল মাঠের জনসভায় কোন্দলের একটি ঘটনা প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রত্যক্ষ করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ওই জনসভায় এমপির বক্তৃতার সময় জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। গত বছরের ২৯ জুলাই ময়মনসিংহের এক সমাবেশে যোগদানকে কেন্দ্র করে গফরগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের সংঘর্ষে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশন চত্বর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মিছিল সমাবেশ করা নিয়ে গত ৩১ মার্চ দুই গ্রুপের বিরোধের জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়েই ভাঙচুর চালানো হয়। গত ৩ মে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মতিউর রহমানকেও গফরগাঁওয়ে দুই জায়গায় সংবর্ধনা দেয় বিবদমান দুই পক্ষ। গত বছরের ২৭ মার্চ যশরা ইউনিয়নের দৌলতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণকাজের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এমপি গ্রুপ ও উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বর্তমান সরকারের আমলেই গফরগাঁওয়ের দক্ষিণাঞ্চলের তিনজন আওয়ামী লীগ নেতা খুন হন। তাঁরা হলেন হাতকাটা কামরুল, মোফাজ্জল এবং এমপির সাবেক এপিএস ইলিয়াস।
এমপির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : অভিযোগ রয়েছে, ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন সংসদ সদস্য হওয়ার পরই উপজেলা সদরে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ৪০ শতাংশ জায়গা দখল করে সেখানে দলীয় কার্যালয় তৈরি হয়। এ ছাড়া তাঁর সমর্থকরা রেলের জায়গাও দখল করেছে। জেলা পরিষদের অর্থায়নে উপজেলার সদরে নির্মিত ডাকবাংলো উদ্বোধনের আগেই এমপি দখল করে নেন। এলাকায় এলে তিনি এই ডাকবাংলোতেই অবস্থান করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ডাকবাংলোর চাবি থাকে কেয়ারটেকারের কাছে।
আরো অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতা গ্রহণের পর এমপি তাঁর জন্মস্থান নিগুয়ারীতে ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ কলেজ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কলেজের নিজস্ব ঘর না থাকায় সাইদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচটি শ্রেণীকক্ষ দখল করে কলেজের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। নিজের কলেজের ভবন নির্মাণের জন্য জেলার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে সাত লাখ টাকা বরাদ্দ নেন। ভবন নির্মাণ না হলেও তা সংস্কারের জন্য আরো পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ নেন এডিপি থেকেই। গফরগাঁও সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিনকে এমপির উপস্থিতিতেই তাঁর ক্যাডাররা ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই কলেজের রাস্তায় ফেলে মারধর করে।
উপজেলার প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এমপির সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরোধের কারণে উপজেলার উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছরে এক কোটি ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকার টেস্ট রিলিফ, কর্মসৃজন কর্মসূচির সাড়ে চার লাখ টাকা, কাজের বিনিময়ে টাকার ৩৫ হাজার টাকা ফেরত যায়। এ ছাড়া এমপির ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, বদলি বাণিজ্য, ডিলারশিপ বাণিজ্যের প্রকাশ্য অভিযোগ আছে। এমপির বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো, তিনি সবার সঙ্গে রুঢ় ব্যবহার করেন। কথায় কথায় ধমক দেওয়া, হুমকি দেওয়া তাঁর সাধারণ অভ্যাস।

No comments

Powered by Blogger.