রাজনৈতিক সংস্কৃতি-দলের (সরকারি) বদল, দেশের বদল by এ কে এম জাকারিয়া

আওয়ামী লীগ বদলালেই দেশ বদলাবে, বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। খুবই সত্যি কথা। দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ, সুতরাং তারা বদলালেই দেশ বদলাবে। আওয়ামী লীগ বদলালে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বদলানো থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে না।


আওয়ামী লীগের বদল অন্য দলগুলোর ওপর যে চাপ তৈরি করবে, তা এড়ানো কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের বদল তাই খুব জরুরি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন, তা অনেকটা এ রকম—‘কাউন্সিলরদের ভোটে নয়, ভবিষ্যতে তৃণমূল নেতাদের ভোটে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচিত হবেন। দেশকে বদলাতে হবে, তবে এর আগে আওয়ামী লীগকে বদলাতে হবে। আওয়ামী লীগ বদলালেই দেশ বদলে যাবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কার্যত দলের সাংগঠনিক নিয়মনীতির পরিবর্তনের কথা বলেছেন। এ ধরনের বদল ঘটাতে পারলে দলে গণতন্ত্রচর্চার একটি সংস্কৃতি শুরু হতে পারে। আওয়ামী লীগে এ ধরনের পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে তিনি দেশকে বদলাতে চেয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৃণমূলের ভোটে নির্বাচিত হলেই কি দেশ বদলে যাবে? নাকি দেশ বদলানোর জন্য আওয়ামী লীগের আরও অনেক ক্ষেত্রে বদল দরকার?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এই বক্তব্য দিয়েছিলেন ১০ এপ্রিল সিলেটে, আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরুর আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায়। তাঁর এই বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ১১ এপ্রিল। সেদিনই বরগুনা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভার খবর বের হয়েছে প্রথম আলোয়। লেখাটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘তৃণমূলের নেতারা কথা বলতে পারলেন না’। সভায় যোগ দেওয়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতার অভিযোগ ছিল অনেকটা এ রকম—‘সরকারে আসার পর দলের সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও নেতা-কর্মীদের দূরত্ব বেড়েছে। সুবিধাভোগী একটি শ্রেণী নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে পড়ায় সাধারণ নেতা-কর্মীরা এখন সুবিধাভোগীদের দাপটে অসহায়। বর্ধিত সভায় দলের এসব বিষয়ে আলোচনা ও দলকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বলে আমাদের আশা ছিল, কিন্তু আসলে এর কিছুই হয়নি। তাই কোনো ফলাফল ছাড়াই এই সম্মেলন থেকে ফিরে যাচ্ছি।’ নেতাদের এ ধরনের অভিযোগ দলে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে না। তবে দলে পরিবর্তন আনার আগ্রহ প্রকাশ বা উদ্যোগ নিলেই দ্রুত সব বদলে যাবে, সেটাও নয়। সরকারি দলের ভেতরের এসব সমস্যা নিয়ে জনগণকে তেমন মাথা না ঘামালেও হয়তো চলে। কিন্তু কিছু বিষয় তো জনগণ কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারছে না।
আওয়ামী লীগ বদলালে দেশ বদলাবে—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এ ধরনের উপলব্ধিমূলক বক্তব্যের পর গত কয়েক দিনে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরও কয়েকটি খবরের দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। ‘গরিবের টাকা লুটে খাচ্ছেন নেতারা’ (১২ এপ্রিল)। এই নেতারা কারা? সরকারি দল বা তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা। তাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে অতিদরিদ্রদের জন্য সরকারের কর্মসংস্থান কর্মসূচির টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন, আবার এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছেন। ‘ডাস্টবিন শৌচাগারও ইজারা নিচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতারা’, ‘উখিয়ায় কর্মসংস্থান কর্মসূচির ১৮ লাখ টাকা ভাগ-বাটোয়ারা’ (খররের ভেতরে আছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে প্রতি লাখে ২৫ হাজার টাকা করে কমিশন দিতে হয়), ‘যুবলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকের দোকানে তালা দেওয়ার অভিযোগ’ (সিলেটের বালাগঞ্জে)—এই তিনটি খবর বের হয়েছে একই দিনের পত্রিকায় (১৯ এপ্রিল)। আরও আছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ‘নদীতীরের মাটি কেটে নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা’ (২০ এপ্রিল), ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অচল, ছাত্রলীগের অবরোধ, শিক্ষক বাসে আগুন’ (২১ এপ্রিল), ‘তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলা’ (২৩ এপ্রিল), ‘বিএনপির কর্মসূচি পালনে বাধা, পল্লবীতে যুবলীগের হামলা’ (২৪ এপ্রিল), নারায়ণগঞ্জে ‘দখলবিরোধী মিছিলে যুবলীগের হামলা’। এই শিরোনামগুলোই সব বলে দিচ্ছে। ভেতরে কী খবর আছে তা আর ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।
এই খবরগুলো বাছাই করা কয়েকটি নমুনা মাত্র। তাও আবার একটি পত্রিকা থেকে নেওয়া। দিন পনেরো সময়কালের মধ্যে যদি সরকারি দল বা তাদের সহযোগী সংগঠনের অপকর্মের এতগুলো খবর বের হয়, তাকে আর যা-ই হোক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই খবরগুলোর মধ্যে সরকারি দলের লোকজনের ভাগ-বাটোয়ারা ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ কামানোর চেষ্টার বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি বিরোধী দলের ওপর হামলার খবরও আছে। সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের হামলার হাত থেকে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির মতো নাগরিক সংগঠনও রেহাই পায়নি। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা এমন করবেনই—এটাকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিলে অবশ্য কোনো কথা নেই। কারণ বিগত জোট সরকারের আমলেও এসব হয়েছে বা হয়তো এর চেয়েও বেশি হয়েছে! সরকারের বদল তাই কাজে দেবে না বা দেশের বদল ঘটাবে না, যদি না সরকারি দল বদলায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের উপলব্ধি সঠিক—সরকারি দল, মানে আওয়ামী লীগ বদলালেই দেশ বদলাবে।
‘বদলের উপলব্ধি’ আর ‘বদল’-এর মধ্যে যে অনেক পার্থক্য, তার জানান দিচ্ছে পত্রিকায় প্রকাশিত ওপরের খবরগুলো। সরকারি দল সরকারি দলের মতোই আছে, বদল হয়নি। কিন্তু ‘আওয়ামী লীগকে বদলাতে হবে’—সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের এই আকাঙ্ক্ষাকে আমরা উপেক্ষা করি কীভাবে? বদলের জন্য সময় লাগে, কিন্তু তাঁর আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কিছু সূচনা-নমুনা তো তিনি বা তাঁর দল দেখাতে পারে। ‘সরকারি দল’ মানেই দলের লোকজন চাঁদাবাজি করবে, কমিশন নেবে, কারও দোকানে তালা ঝুলিয়ে দেবে, নদী থেকে বালু তুলে নেবে—এগুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে না নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। দলের কারও বিরুদ্ধে যখন এ ধরনের অভিযোগ উঠবে, তখন তদন্ত করে দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়ে কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে সরকারি দল। দলের পক্ষ থেকে মাসে একবার প্রয়োজনে সংবাদ সম্মেলন করে বড় বড় অভিযোগের তদন্তের ফলাফল ও অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানানো যেতে পারে। আগে কোনো সরকারি দল এ কাজ করেনি, আওয়ামী লীগ তা করে দেখাতে পারে যে তারা দলে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে দেশের পরিবর্তন আনতে চায়। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যদি কাজটি করতে পারে, তবে ভবিষ্যতের যেকোনো ‘সরকারি দলের’ পক্ষে এ ধরনের কাজ থেকে সরে আসা কঠিন হবে।
এগুলো সাংগঠনিক উদ্যোগ ও ব্যবস্থার বিষয়। কিন্তু সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নানা অপকর্মের বিষয়গুলো তো স্রেফ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। আইন যদি নিজের গতিতে চলে, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের ভয় পেয়ে পুলিশ পিছিয়ে আসবে না—এ ধরনের পরিবেশ যদি নিশ্চিত করা যায়, সেটাও বড় বদল হিসেবে বিবেচিত হবে। সরকারি দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে। সরকারি দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়িত আছেন, এমন কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে সরকার দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। দেশবদলের আলামত তখনই স্পষ্ট হতে শুরু করবে।
আমাদের আরেক চেনা বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি দল মার দেবে আর বিরোধীরা মার খাবে। পানি, বিদ্যুত্ ও গ্যাসের দাবিতে যখন বিএনপি সভা-সমাবেশ করেছে, তখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে এরই প্রমাণ রেখেছেন। বর্তমানে গ্যাস, বিদ্যুত্ ও পানির যে সংকট; তার দায় নিশ্চয়ই বিএনপিকেও নিতে হবে। কারণ তারা ক্ষমতায় থাকতে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি, লুটপাট ও যথাযথ কাজ না হওয়ায় পরিস্থিতি আজ এখানে এসে ঠেকেছে। কিন্তু এখন বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কি এসব ইস্যুতে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারবে না? আমাদের আরও জানার বিষয়টি হচ্ছে, বিএনপি পানি-বিদ্যুত্-গ্যাস ইস্যুতে কোনো সমাবেশ ডাকলে তাতে দলীয় লোকজন দিয়ে হামলা চালানোর রাজনৈতিক অবস্থান কি সরকারি দল নিয়েছে? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে সরকারি দল ঘোষণা দিয়ে বলুক যে বিদ্যুত্-পানি-গ্যাস নিয়ে বিএনপিকে রাস্তায় কোনো সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না এবং এই সমাবেশ ঠেকাতে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারও ব্যবহার করা হবে। কিন্তু আমরা নিশ্চিত যে উত্তরটি ‘না’সূচক হবে এবং সে কারণেই জনগণের জানা উচিত যে কারা অতি উত্সাহী হয়ে এই কাজ করল? বিএনপির সমাবেশে হামলাকারী হিসেবে যেহেতু সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের নাম এসেছে, তাই দলটির উচিত বিষয়টি পরিষ্কার করা; দলের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
এতটা না পারা গেলেও অন্তত সতর্ক করে দেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের কাজ না করে। সরকারি দল যদি এটি করতে পারে, তবে দলের এই গুণগত পরিবর্তন দেশের কাজে লাগবে। তখন দেশ বদলাতে শুরু করবে, আমরা বলতে পারব সরকারি দল মার দেবে আর বিরোধীরা মার খাবে—এই জায়গা থেকে দেশ সরতে শুরু করেছে।
সরকারি দল বদলালেই দেশ বদলাবে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.