আমিনবাজারে ছয় ছাত্র হত্যা পুলিশের অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন-পুলিশের সার্বিক ভূমিকা ছিল অপেশাদার ও দায়িত্বহীন by গোলাম মর্তুজা

রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সাভার থানা পুলিশের সার্বিক ভূমিকা ‘অপেশাদার ও দায়িত্বহীন’ ছিল বলে মনে করে পুলিশেরই অনুসন্ধান কমিটি। গত বছরের ১৭ জুলাই রাত সাড়ে ১২টা থেকে সোয়া একটার মধ্যে বড়দেশী গ্রামের পাশে কেবলার চরে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।


ঘটনার পর স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জনের বিরুদ্ধে একটি ডাকাতির মামলা এবং পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠলে অনুসন্ধানে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রধান তৎকালীন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) (বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত আইজিপি) আমির উদ্দিন। কমিটির বাকি তিন সদস্য হলেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার মাসুদ করিম, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার শেখ মো. রেজাউল হায়দার এবং ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম।
দীর্ঘ তদন্তে কমিটি ১৬ জন পুলিশ-সদস্য ও ঘটনাসংশ্লিষ্ট ৩৯ জন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জবানবন্দি নেয়। এর বাইরে আরও ৪৬ জনকে ঘটনা সম্পর্কে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করে।
অনুসন্ধান কমিটি ডাকাতি মামলার বাদী মালেকের বক্তব্য পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছে, থানায় দায়ের করা এজাহার ও তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যের তথ্যে যথেষ্ট গরমিল রয়েছে। মালেক বলেছেন, তিনি গদিঘরে ডাকাতির পর কোনো চিৎকার দেননি বা ঘর থেকে বেরও হননি। নিহত ছয়জনের মধ্যে তিনি কোনো ‘ডাকাত’কে শনাক্ত করতে পারেননি। তিনি ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখানোর কথা বললেও উদ্ধার হওয়া ছুরিগুলোই সেই ছুরি কি না, তা শনাক্ত করতে পারেননি। পরে সিআইডি মালেককে গ্রেপ্তার করে।
সাভার থানার তখনকার কর্তব্যরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ ফরিদ কমিটিকে বলেন, পরদিন দুপুর ১২টার দিকে সাভার থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাবুবুর রহমান নিজে মালেকের দায়ের করা ডাকাতির মামলাটি রেকর্ড করেন। সকাল সাতটার মধ্যে নিহত ছাত্র শামস রহিম শাম্মামের মা-বাবা সাভার থানায় গিয়ে তাঁদের ছেলের লাশ শনাক্ত করলেও প্রাপ্ত সংবাদের বিষয়ে কোনো জিডি করেননি ওসি।
সাভার থানার তৎকালীন ওসি মাহাবুবুর রহমান কমিটিকে বলেছেন, রাতে ডাকাতির ঘটনা শুনে তিনি এসআই হারেস শিকদার ও এসআই আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে দুটি দলকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। নিজেও একটু পর সেখানে যান। তিনি গিয়ে দেখেন অজ্ঞাতনামা ছয়জনকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। সকালে ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের কোনো অভিভাবক থানায় এসে কোনো তথ্য জানাননি। আহত আল আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তিনি জানতে পেরেছেন তাঁরা সবাই ছাত্র। তবে কর্তব্যরত কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে ওসির এই বক্তব্য মেলেনি বলে অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।
পুলিশের আচরণ অপেশাদার-দায়িত্বহীন: ওই ঘটনায় পুলিশের সার্বিক ভূমিকা ও পূর্বাপর ব্যবস্থা সম্বন্ধে কমিটির অনুসন্ধানে পুলিশের অপেশাদার আচরণ, দায়িত্বহীনতা আর অপরাধ ঠেকাতে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাভার থানার এসআই হারেস শিকদার ও আনোয়ার হোসেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কোনোটাই করেননি বা যথাযথ ‘পুলিশি অ্যাকশন’ নেননি। এমনকি ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানোর জন্য কোনো চাহিদাও জানাননি। এ ক্ষেত্রে দুই এসআই পুলিশি পেশাদারির পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডাকাতি সন্দেহে এত বড় ঘটনা দেখেও কোথায় ডাকাতি হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্তের চেষ্টা করেনি। জনতার পিটুনি থেকে একজন আহত ব্যক্তিকে (আল আমিন) উদ্ধার করে ডাকাত হিসেবে আদালতে চালান দেওয়া পেশাদারসুলভ হয়নি। এ ক্ষেত্রে সাভার মডেল থানার ওসি এবং ঘটনাস্থলে যাওয়া এসআই হারেস ও এসআই আনোয়ারের পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন ছিল। ঘটনা অনুসন্ধানে ওসিকে বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন ছিল।
এ ঘটনার পর সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। মালেকের করা ডাকাতি মামলাটি ১২টা পাঁচ মিনিটে এবং এসআই আনোয়ারের করা হত্যা মামলাটি এর ২০ মিনিট পর রুজু হয়। মামলা দায়েরের আগেই নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় জানা সম্ভব ছিল। নিহত শাম্মামের মা ও বাবা সকালেই সাভার থানায় গিয়ে লাশ শনাক্ত করেছেন। কিন্তু সাভার থানার পুলিশ নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় জানার চেষ্টা না করেই মামলা রুজু করে। মামলা রুজু হওয়ার আগেই বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে নিহত ব্যক্তিদের ছাত্রপরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পরও মামলায় তাঁদের ডাকাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সর্বস্তরে প্রশ্ন ওঠে। এখানেও এসআই আনোয়ার ও ওসি মাহাবুব দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা শত শত লোককে হাতে লাঠি, বাঁশ, রড, রামদা ইত্যাদিসহ দেখলেও তাঁদের কাউকেই গ্রেপ্তার বা শনাক্ত করার চেষ্টা করেননি। এখানেও ওসি এবং দুই এসআইয়ের আন্তরিকতার অভাব ছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এর আগে বড়দেশী গ্রামে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও পুলিশ কোনোটিরই রহস্য উদ্ঘাটন ও প্রকৃত ডাকাতদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এখানেও তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ওসির আন্তরিকতার অভাব প্রকাশ পায়। এলাকাটির ডাকাতি বন্ধে ওসি নিবারণমূলক ব্যবস্থাসহ কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে বড়দেশী গ্রামে কোনো উল্লেখযোগ্য অপরাধবিরোধী সভা করেননি বলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। ওই এলাকার মাদকসেবী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধেও কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি ওসি।
অনুসন্ধানের শেষে বলা হয়, নিহত ছয় তরুণ ও আহত তরুণ আল আমিনের সম্পর্কে কোনো বিরূপ তথ্য পাওয়া যায়নি।
দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দুই এসআইয়ের পদাবনতি করা হয়েছে। ছয় কনস্টেবলের শাস্তি হয়েছে। ওসির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার সূত্র জানায়, অভিযুক্ত ওসি মাহাবুবুর রহমান বর্তমানে গাজীপুরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। এসআই হারেস ফরিদপুরে আর আনোয়ার হোসেন রাজবাড়ীতে কর্মরত রয়েছেন।
নিহত ছাত্ররা: নিহত ছয়জন হলেন: ধানমন্ডির ম্যাপললিফের এ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শাম্মাম (১৭), মিরপুর সরকারি বাঙ্লা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণীর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল (২১), একই কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান (২০) ও উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান (১৬), তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান (১৯) এবং মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব (২০)।

No comments

Powered by Blogger.