এসো নীপবনে-এক স্মৃতিকাতরের অনুরোধ by আবুল হায়াত

কথাটা শুনে আমি তো হতভম্ব। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক তাকিয়ে রইলাম ছেলেটার দিকে। তারপর প্রচণ্ড রাগ হলো, কিন্তু কী আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গেই আবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলাম। ভদ্রতাসুলভ দেঁতো হাসিটা দিতে আর দেরি হলো না আমার।
ঘটনা ঘটেছিল কালীগঞ্জের মৈশাইর গ্রামে। যাও পাখি ধারাবাহিকের শুটিংয়ের জন্য প্রতি মাসেই একবার করে যেতে হয় মৈশাইর। সেদিন সকাল থেকেই শুটিং করে বিকেলে একটু বিশ্রামের আশায় বসে ছিলাম শুটিং স্পটের বাড়িটার সামনে পুকুরঘাটে। একাই বসে ছিলাম, আনমনে ভাবছিলামও হয়তো কিছু। হঠাত্ খেয়াল করি, দুটি ছেলে, যুবকই বটে, সামনে এসে দাঁড়াল। প্যান্ট-শার্ট পরা। এখন গ্রামগঞ্জেও লুঙ্গির চল উঠে গেছে বললেই চলে। হঠাত্ই ওদের একজন অনেকটা ঝাঁপ দেওয়ার মতো করে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে তার বন্ধুকে বলল—
‘চাচার সাথে আমার একটা ছবি তুইলা দে, চাচার বয়স হইছে, কবে যায়গা তার কি ঠিক আছে!’
এ রকম কথা শোনার পর রাগ হয় কি না বলেন! আমার তো হয়েছিল, নিজেকে নিয়ন্ত্রণও করেছিলাম আশ্চর্যজনকভাবে। হেসে বলেছিলাম—
‘তোলো বাবা, মৃত্যুর কি কোনো ঠিক আছে। কাল সকালে তুমিও থাকো কি না তার নিশ্চয়তা কী?’
খোঁচাটা না বুঝেই হেসে ছবি তুলে প্রসন্ন মনে বিদায় নিল দুই বন্ধু।
পরে ভাবনাটা মনে ঘুরেফিরে এল, রাগ হলো কেন আমার? বুড়ো তো হয়েইছি। এটা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। উপায় নেই জেনেও আমরা করি অস্বীকার। আমরা আসলে বুড়ো হতে ভয় পাই না, ভয় পাই যৌবন হারাতে।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মানুষ শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব—সবকিছু পেরিয়ে একসময় পৌঁছায় বার্ধক্যে। এতে লজ্জা পাওয়ার বা বিব্রত হওয়ার তো কিছু নেই। বরং অনেকের মতে, এ বড়ই আনন্দের ব্যাপার। কারণ, একজন বৃদ্ধ মানুষ তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতার কারণে অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর জানেন। আবার আর এক দলের ধারণা, এই জানাটাও একই সঙ্গে দুঃখজনক ব্যাপার। কারণ, কেউ আর তখন ওই সব প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে জানতে চায় না। তখন সব জানার আনন্দ আর কেউ জানতে না চাওয়ার কষ্ট মিলেমিশে আপনার ভেতরে এক ধরনের ইনার্ট অনুভূতি তৈরি হয়। ফলে আপনার মাঝে বেশ কিছু লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যাকে বলা হয় বার্ধক্যের মাপকাঠি।
পত্রিকান্তরে যদিও আমি একবার এই মাপকাঠির তালিকা আপনাদের খেদমতে উপস্থাপন করেছিলাম। তবুও আর একবার আপনাদের রেডি রেফারেন্সের সুবিধায় বলতে চাই।
আপনি হয়তো নিজেকে বুড়ো ভাবতে নারাজ। ঠিক আছে, ভাববেন না, ক্ষতি নেই। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে নিচের তালিকাটার সঙ্গে একবার নিজেকে মিলিয়ে দেখতে অসুবিধা নেই নিশ্চয়। দেখুন তো, বার্ধক্যের কোন পর্যায়ে আছেন আপনি!
প্রথম পর্যায়ে আপনি চেনাজানা মানুষের নাম ভুলে যাবেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আপনি ভুলে যাবেন চেনাজানা মানুষদের চেহারা।
তৃতীয় পর্যায়ে ভুলবেন প্যান্টের চেইন লাগাতে।
এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ের বার্ধক্যে আপনি প্যান্টের চেইন খুলতেই ভুলে যাবেন।
এ বড় দুঃখজনক এক অবস্থা বটে, কিন্তু এড়ানোর উপায় নেই। তবে এই যে চতুর্থ পর্যায়ের বুড়োরা অনেক অনেক স্মৃতির ভার থেকে যেমন মুক্তি পান, তেমনি ঘুমোতে যাওয়ার আগেও আরও কিছু থেকেও লাভ করেন মুক্তি। যেমন ধরেন, শোয়ার আগে কানটা রাখেন ড্রয়ারে, দাঁতটা রাখেন কাপে, আর টেবিলে চোখ।
তার পরও অনেকে গভীর রাতে দেখেন সৃষ্টিকর্তার আলো। কীভাবে? শুনুন তাহলে—
এক বৃদ্ধা তাঁর ৯০ বছরের বৃদ্ধ স্বামীকে চিকিত্সকের কাছে নিয়ে গেছেন নিয়মিত চেকআপের জন্য। চিকিত্সক মহিলাকে ১০ মিনিটের জন্য বাইরে অপেক্ষা করতে বলে বুড়োকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বৃদ্ধাকে ডেকে বললেন—
‘আপনার স্বামীর শারীরিক, মানসিক অবস্থা উভয়ই চমত্কার। তবে উনি বলছিলেন, গত রাতে উনি নাকি অলৌকিক আলো দেখেছেন।’
‘তাই নাকি। কীভাবে?’
‘উনি বললেন, কাল গভীর রাতে উনি ছোট কাজে বাথরুমে গিয়েছিলেন। দরজাটা খুলতেই বাথরুমে অলৌকিক আলো জ্বলে উঠল। আর কাজ সেরে উনি দরজা বন্ধ করতে যেতেই অলৌকিক আলোটা নিজে নিজেই নিভে গেল।’
‘দেখেছেন, বদমাশ বুড়ো আজ আবার ফ্রিজে পেসাব করেছে।’ ভীষণ ক্ষিপ্ত বৃদ্ধা। ভয় পেলেন? দুঃখিত, আপনাদের ভয় দেখানোর কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে লিখতে বসিনি আমি, বরং বলতে চাইছি, এক-তৃতীয় পর্যায়ের বৃদ্ধের কথা, যার পুরোনো বহু স্মৃতি ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে শুধু একটা সংবাদ পড়ে। সংবাদটা নিশ্চয় নজরে পড়েছে আপনাদেরও।
‘ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে...।’
আহা রে উত্তম, সুচিত্রা, দিলীপ কুমার, মধুবালা, সাবিত্রী, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, রাজকাপুর, নার্গিস, দেবানন্দ, সৌমিত্র, অরুন্ধতী দেবী—কত কত সব চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে পড়ে গেল, বাবা-মাকে লুকিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চট্টগ্রামের উজালা, নিরালা, খুরশিদ মহল, সিনেমা প্যালেস, লায়নে কত সিনেমা দেখেছি সদলবলে। আবার ওদের দেখব নিজেদের সিনেমা হলে! সেই সব আনন্দের দিনগুলো মনে করে চোখে এসে গেল পানি। বৃদ্ধদের অবশ্য এই আর এক রোগ। কথায় কথায় চোখ ভিজে আসে। তবে এ কথা ভেজা চোখেই বলছি—যতই ভারতীয় ছবি দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠুক না কেন, দেশের সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত করে কখনোই নয়। নিশ্চয়ই নয়।
ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়ায়। তবে অনুরোধ আর একটি করব—ওরা যখন আমাদের সংস্কৃতিকে পদে পদে অবজ্ঞা করছে প্রতিনিয়ত, আমাদের সিনেমা ওই দেশের প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলেছে শুনিনি। আর আমাদের টেলিভিশন চ্যানেল সমভাষী পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের কাছে আজ অবধি নিষিদ্ধ। আমরা কি ওই দিকের জানালাটা বন্ধ করে দিতে পারি না দেশের স্বার্থে, সে যত মন খারাপই হোক।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.