বাঘা তেঁতুল-রামদাবাদী ছাত্ররাজনীতি by সৈয়দ আবুল মকসুদ

সংবাদপত্রের প্রথম পাতাকে মনে হয় যেন খেলাধুলার পাতা। যেমন বুধবারের কাগজ। চট করে মনে হবে ক্রিকেট খেলা চলছে। ক্রিকেট তারকা সুনীল গাভাস্কার, আজহারউদ্দিন, ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আখতারদের মতোই সুদর্শন ও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। জিনসের প্যান্ট ও দামি গেঞ্জি পরা। কারও বা ট্র্যাকস্যুট। পায়ে কেডস।


মনে হবে, ব্যাটসম্যান ব্যাট করছেন। তবে একজন নয়, অনেকে। নানা রকম ব্যাট। কোনোটা পাতলা-চিকন। আসলে যাকে ব্যাট মনে হবে, সেটা ব্যাট নয়, রামদা। খেলোয়াড় বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগের দুই পক্ষ।
ইত্তেফাক-এ ছাপা হয়েছে দুটি ছবি। প্রথমটিতে লাল গেঞ্জি পরা ও হালকা বেগুনি গেঞ্জিওয়ালারা ব্যাট করছে। ব্যাটিং হবে সাদা গেঞ্জি পরা একজনের পিঠে। তারও পূর্বপ্রস্তুতি ছিল। নিচের দিকে প্যান্ট কিছুটা গোটানো। ওই পিঠের যদি মুখ থাকত তা হলে বলত, আঘাত কাকে বলে। দ্বিতীয় ছবিটিতে একজন ধরাশায়ী। কোরবানির পশুর মতো তাকে চেপে ধরছে একজন। তার গলা বরাবর একজন জল্লাদ। প্রকাণ্ড রামদা। তার সহকারী দুজন।
আমার দেশ-এর আলোকচিত্রটির বিষয়বস্তু ভিন্ন। সিমেন্টের বেদির ওপর শোয়ানো হয়েছে এক আজহারউদ্দিনকে। একজন রামদা দিয়ে কোপ দিতে উদ্যত। আরেকজন সহায়তা করছে। প্রথম আলোর ছবিটিতে শোয়েব আখতাররা পাঁচজন। নারকেলগাছের গুঁড়ির পেছন থেকে একজনের মুখটা দেখা যাচ্ছে। তার হাতে প্রকাণ্ড লাঠি। সে লাঠি পড়ছে বেদিতে বসে থাকা একজনের পাঁজরে। বসে থাকা ক্রিকেটারের গলা জড়িয়ে ধরেছে তার এক অভিন্নহূদয় বন্ধু। তার হাতেও রামদা। পেছন থেকে লাল গেঞ্জিওয়ালা বিশাল রামদা দিয়ে কোপ মারছে। তার পেছনে রামদা নিয়ে আরেকজন। প্রথমজন ব্যর্থ হলে সে কাজ চালাবে। যায়যায়দিন-এর প্রথম ছবিটি আমার দেশ-এর ছবির মতোই। দ্বিতীয়টিতে এক জখমি খেলোয়াড়কে পাঁচজন ধরাধরি করে কোথাও নিচ্ছে। তবে একটি বাড়তি ছবি আছে যাযাদিতে, তা হলো ‘ছাত্রলীগ নেতার মোটরসাইকেল থামিয়ে কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায়’ বেধড়ক পিটুনি খাওয়া এক ‘হতভাগ্য পুলিশ কর্মকর্তা’।
ডেসটিনিতে প্রকাশিত ছবিতে যে মার খাচ্ছে এবং যে মার দিচ্ছে দুজনেরই হাতে বঙ্গীয় আধুনিক অস্ত্র। বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ দুটি ছবি। প্রথমটিতে ক্ষুরধার রামদা কয়েক ইঞ্চি বসে গেছে বেদিতে বসা সশস্ত্র বন্ধুর পিঠের মাংসে। সমকাল-এর ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, কলাগাছে যেমন মানুষ দা দিয়ে কোপ দেয়, সেভাবে সহপাঠীকে কোপ মারছে রামদা দিয়ে।
উপমহাদেশের মানুষ দা ব্যবহার করছে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সময় থেকে। গৃহস্থালির কাজে পাতি দা-ই ব্যবহূত হয়। রামদা জিনিসটি লোহালক্কড়ের দোকানেও পাওয়া যায় না, কামারকে অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়। যার যেমনটি পছন্দ। কেউ চায় দেড় ফুট, কেউ দুই-আড়াই ফুট। বেশি লম্বা হলে নিরাপদ দূরত্ব থেকে কোপ দেওয়া যায়। আগে চোর-ডাকাতেরা ডাকাতি বা রাহাজানির সময় রামদা ব্যবহার করত।
প্রতিদিনের একই অবস্থা। তবু বুধবারের কাগজগুলোতে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা চোখ বুলিয়েছেন। ধারালো রামদা ঝলসে ওঠা দেখে তাঁদের কী অনুভূতি হয়েছে তা জানতে পারিনি। অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ যাকে ছাত্ররাজনীতি বলছেন, তা হলো নব প্রজন্মের প্রগতিশীল রামদানীতি। এর মধ্যে ছাত্রত্ব বা রাজনীতিত্বের বিন্দুমাত্র সংস্রব নেই। ছাত্ররাজনীতি ছিল একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত।
যে ছাত্রলীগকে চিনতাম ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে, সে ছাত্রলীগের মৃত্যু হয়েছে। সে ছাত্রলীগ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী—রামদাবাদী নয়। সেই প্রতিবাদী ছাত্রলীগ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে, স্বাধীনতা চেয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একাত্তরে সেই লীগের নেতারা স্টেনগান হাতে তুলে নিয়েছেন কিন্তু রামদা নয়। রামদা ছিল রাজাকারদের হাতিয়ার। একাত্তরে ছাত্রলীগের কর্মীরা পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় উড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু একজন শত্রুরও পায়ের রগ কাটেনি। পায়ের রগ কাটার অভ্যাস মধ্যযুগ ও মধ্যপ্রাচ্যপন্থীদের।
‘স্বাধীনতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’—এসব শব্দবন্ধ আজ প্রতিমুহূর্তে উচ্চারিত। রামদাবাদীদের মুখেই আজ ওসব বেশি ধ্বনিত হয়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকটি শব্দবন্ধ: ‘বাংলার মাটি’। যেন ইটখোলার মালিকদের মতো সরকারি দল ও তাদের উপসংগঠনগুলো কিনে নিয়েছে সারা বাংলার মাটি ও তাতে যা আছে তার সবই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশের মানুষের ভাগ্যবিধাতা সরকার আর সরকারের ভাগ্যবিধাতা ছাত্রলীগ।
প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ছাত্রলীগ দুর্গ গড়ে তুলেছে। যেমন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী রবার্ট ক্লাইভ। রামদাবাদী ‘ছাত্রনেতারা’ তাদের যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে। কারোরই মাফ নেই। নবযুগের বঙ্গবীরদের হাতে টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন সেদিন। তাঁর গাড়ি চুরমার হয়েছে। তেল-গ্যাস জাতীয় কমিটির সবচেয়ে নিরীহ মিছিলে হামলা হয়েছে। টিউশন ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মিছিলে হামলা হয়েছে। বুধবার নাটোরে বিএনপির গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। নিহত হয়েছে একজন, আহত শতাধিক। এর নাম গণতান্ত্রিক রাজনীতি।
অথচ যেদিন তিনোদ্দীনের সরকার শেখ হাসিনাকে বিশেষ কারাগারে নিয়ে বন্দী করে, সেদিন রামদাবাদীরা একটু প্রতিবাদও করেনি। ২০০৭-এ তো তারা নাবালক ছিল না, সবারই দাড়িগোঁফ গজিয়েছিল। একাত্তরে দাড়িগোঁফ না গজানো মুক্তিযোদ্ধাই ছিল বেশি। শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য আমাদের মতো অক্ষমই কাগজের পাতায় হোক, টক শোতে হোক বা গোলটেবিলে হোক, যেটুকু পেরেছে, বলেছে।
রামদাবাদী ছাত্রনেতা ও কর্মীরা তাদের কীর্তির চেয়ে মহৎ। সোয়া বছরে যা ঘটেছে তা ইতিহাসের অমূল্য উপাদান। আগামীকালই যদি বামদাবাদীরা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে এবং শিক্ষাঙ্গনগুলো জুরিখ বা বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শান্তিপূর্ণ হয়ে যায়, তবু এনএসএফের মতো চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ছাত্রলীগ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.