কলকাতার চিঠি-মমতার এক বছর এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তি by অমর সাহা

২০ মে। ঠিক এক বছর আগে এদিনেই পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় এসেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অবসান ঘটিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের একটানা বাম শাসনের। বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। পরিবর্তনের হাওয়া তুলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে মাত করে দিয়েছিলেন তিনি।


সঙ্গে অবশ্য ছিল জাতীয় কংগ্রেস। সেই মমতা তাঁর শাসনের এক বছর পূর্ণ করেছেন ২০ মে। কলকাতার মিলনমেলা ময়দানে মমতার এক বছরের শাসনের পূর্তিতে আয়োজন করা হয়েছে সপ্তাহব্যাপী প্রগতি উৎসবের।
মমতা তাঁর শাসনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দাবি তুলেছেন, ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি দেওয়া সব কাজই সম্পন্ন করেছেন। পাঁচ বছরের কাজ এক বছরেই সেরে ফেলেছেন। এখন সেই কাজগুলো তদারক করা আর নতুন নতুন উন্নয়নমুখী কাজ করাই হবে তাঁর লক্ষ্য। মমতার এই ঘোষণাকে অবশ্য আমলে নেয়নি বিরোধীরা। তাদের কথা, চমক দিতে পটু মমতা। তাই চমক দিচ্ছেন। মমতা জানেন, বারবার একটি মিথ্যা কথা বললে সেই কথাটি একসময় সত্য হিসেবেই মেনে নেয় মানুষ। মমতা এখন সেই পথেই হাঁটছেন। তবে এ কথাও সত্য, মমতা বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। পরিবর্তনও এনেছেন। তবে যতটা বলছেন, ততটা করেছেন কি না তাই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের শেষ নেই। মমতার হরতাল-বিরোধী ভূমিকা, গণতন্ত্রের পরিবর্তে দলতন্ত্র চালু, তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনে আপত্তি, ছিটমহল নিয়ে নীরব থাকা, কার্টুন কাণ্ড নিয়ে অধ্যাপককে হেনস্তা করা, কোন সংবাদপত্র গ্রন্থাগারে রাখা হবে, কোন টেলিভিশন চ্যানেল মানুষ দেখবে— তাঁর এধরণের অবস্থান নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছেই। তবুও মমতা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি তাঁর কথা রেখেছেন, প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন, তাঁর সরকারের পাঁচ বছরের কাজ এক বছরেই শেষ করেছেন।
কী করেছেন মমতা এই এক বছরে? মমতা এবং তাঁর দল ও সরকারের সূত্র থেকে পাওয়া এই কাজের ফিরিস্তি। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়া হয়েছে, ঘোষণা দেওয়া হয়েছে শিল্পের জন্য আর নতুন করে জোর করে কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। শিল্পপতিদের নিজেদের জমি কিনতে হবে। তবে রাজ্যে থাকবে জমি ব্যাংক। কিষান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কম সুদে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রকল্প চালু করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ৯৫ হাজার কোটি রুপির বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। রাজ্যে ১০টি মহিলা পুলিশ থানা চালু করা হয়েছে। জঙ্গলমহলে মাওবাদী সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরে এসেছে। দার্জিলিং সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে জিটিএ বা গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ৩৪টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়া হয়েছে।
এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে দুই লাখ ৮৫ হাজার কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। ক্ষুদ্রশিল্পে আরও এক লাখ ২৫ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থীদের বয়সসীমা ৪০ বছর করা হয়েছে। ১৮ হাজার ৫০০টি পুকুর খনন করা হয়েছে। ১০ হাজার মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মসজিদের ইমামদের মাসিক দুই হাজার ৫০০ এবং মুয়াজ্জিমদের এক হাজার রুপি ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৯টি জেলায় নতুন ১৯টি সংখ্যালঘু ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরও এক হাজার ৪৯২টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। আর ইতিমধ্যে নতুন করে খোলা হয়েছে দুই হাজার ৫২২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য গড়া হয়েছে বন্দীমুক্তি রিভিউ কমিটি। এধরণের আরো কিছু কাজ সফল্যের দাবি করছে মমতা সরকার। কিন্তু সত্যি কি মমতা যে খতিয়ান বা ঘোষণা দিয়েছেন তা করেছেন। একজন রাজনৈতিক নেতা তো বলেছেন, কেউ কি আসলে খোঁজ নিতে যান? এখনো হাজার হাজার মানুষ বেকার। অথচ মমতা বলেছেন, প্রায় তিন লাখ মানুষের সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছে। কোথায় দিয়েছেন তার খোঁজ কে রাখে? এক হাজার জনকে দিয়ে এক লাখ ঘোষণা করলে দোষ কোথায়!
বামফ্রন্টের এক শীর্ষ নেতা এবং সিপিআইর রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেছেন, চমকের রাজনীতিতে বরাবরই পটু মমতা। এসব মমতার চমক ছাড়া আর কিছু নয়। এবার আমরা বামফ্রন্ট পুস্তিকা আকারে জানিয়ে দেব, কী করেছেন মমতা এই এক বছরে? তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, সিঙ্গুর সমস্যার সমাধান হলো কই? সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকেরা তো জমি পাননি এখনো। দার্জিলিং নিয়ে জিটিএ চুক্তি হলেও তা মানছে না ডুয়ার্স ও তরাইর মানুষজন। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাও অনড় রয়েছে জিটিএতে ডুয়ার্স ও তরাইকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে। কিষেনজিকে হত্যা করে তো আর মাওবাদীদের সমস্যা সমাধান হয়ে যায়নি। এখনো তৎপর মাওবাদীরা। এদিকে জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘এক বছরে শুধুই প্রতিশ্রুতি, রূপায়ণে ব্যর্থ মমতা।’
শুধু কি তা-ই, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে নীরব থেকেছেন মমতা। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করতে চাইলেও মমতা এখনো সবুজ সংকেত দেননি। ছিটমহল সমস্যা এবং বিনিময়ের দাবিতে ছিটমহলবাসী আন্দোলন চালিয়ে গেলেও মমতা নীরব থেকেছেন। তবে সরব হয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনকে কলকাতায় আনতে পেরে। হিলারিও মমতার প্রশংসা করেছেন। মমতাও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার পশ্চিমবঙ্গের শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে এই এক বছরে আর একটি চিত্র ভেসে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। শাসক জোটের দ্বিতীয় শরিক জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার নির্বাচনী আঁতাত ভেঙে গেছে। সম্পর্ক শীতল হয়েছে। আসন্ন এই রাজ্যের ছয়টি পৌরসভার নির্বাচনে এবার কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস আলাদাভাবে লড়ছে। এর আগে এই রাজ্যের কংগ্রেস দলীয় এক মন্ত্রী মমতার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পদত্যাগ করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের আর এক বিরোধী নেতা বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহার একটি মন্তব্য দিয়েই শেষ হোক লেখাটি। ‘এ তো ঘোষণার সরকার, কথা বলার সরকার। গিনেস বুকে যদি সেরা ঘোষণার জন্য পুরস্কার দেওয়ার বিধান থাকত, তবে সেই পুরস্কার মমতাই পেতেন।’ তিনি কটাক্ষ করে আরও বলেছেন, ‘অপেক্ষা করুন, কিছুদিনের মধ্যেই এর ফল পেতে শুরু করবে রাজ্যবাসী।’
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.