যুগের বাণী-মাইক্রো-ক্রেডিট নিয়ে গল্পসল্প by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

মাইক্রো-ক্রেডিট ইংরেজি ভাষার। শব্দটির বাংলা ভাষার প্রতিশব্দটি শিরোনামে ব্যবহার না করার কৈফিয়ত পরে দিচ্ছি। এর আগে মাইক্রো-ক্রেডিট নিয়ে কেন লিখছি সেটার কৈফিয়ত দিতে হয়। সপ্তাহজুড়ে প্রতিটি দৈনিক খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হচ্ছে একটি খবর, যার বিষয় ড. ইউনূস এবং কেন তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে থাকবেন না?


প্রশ্নটি উঠেছে যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে ওই পদে থাকার বয়সসীমা ৬০ বছর, অথচ তাঁর বয়স ৭০ বছর পার হলেও তিনি সে পদে কাজ করে যাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, ড. ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয়নি, বরং তিনি আইন অনুযায়ী আপনা-আপনি অপসারিত হয়ে আছেন এবং তাঁকে সংশ্লিষ্ট আইনটি জানানো হয়েছে। একজন নোবেল-লরেট কিংবা অর্থনীতি বিদ্যায় ডক্টরেট হলেও যে ড. ইউনূস আইনটি ইতিপূর্বে জানতেন এটা ভাবা ঠিক হবে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি আইনজীবীদের পরামর্শ চেয়েছেন এবং তাঁদের আইনি পরামর্শ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করেছেন। এখন রায় পাওয়া গেল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক উলি্লখিত বিধিটি ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না।
মাইক্রো-ক্রেডিট শব্দগুচ্ছটির প্রতিশব্দ কি ক্ষুদ্রঋণ? উত্তরটি কী হবে এই নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকায় শিরোনামে মূল ইংরেজি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছি। মাইক্রো শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ ক্ষুদ্র লিখলে কিংবা বললে মূল শব্দটির সঠিক অর্থটি আমাদের ধারণায় স্পষ্ট হয় না। কারণ এই ইংরেজি শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ একাধিক, যথা_ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অণু। কাজেই ক্ষুদ্রঋণ বলতে বোঝায় এমন পরিমাণ যা একজন দরিদ্রের জন্য এমন যথেষ্ট, যা তার কাছে অতিরিক্ত বা অসহনীয় নয় এবং উল্টো করে বলতে, একজন নিম্নবিত্তের কাছে আদৌ সেটা বেশি নয়। অনেকে বলে থাকেন, ক্ষুদ্রঋণ হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণের ওষুধ। কথাটির পিঠে এ প্রশ্নটি করা যেতে পারে এ ওষুধটির কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? কী আশ্চর্য! জানা গেল, আছে এবং সেটা গুরুতর ও আত্মঘাতী। যখন গল্পসল্পই লিখছি, তখন এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি, যেটা সত্য ঘটনাও বটে। ১০ বছর আগে একদা নাকে সর্দি বসে নিঃশ্বাস নিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তখন আমি সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গেলাম সেখানকার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালের কান-নাক-গলা বিশেষজ্ঞের কাছে। ধরা পড়ল আমার নাসিকা নালিতে সমস্যা আছে এবং ব্যবস্থাপত্রে কয়েকটি ওষুধ দেওয়া হলো। দেশে ফিরে ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে দেখা গেল একটা ট্যাবলেট খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লেখা আছে মৃত্যু। আমি ট্যাবলেট খাওয়া বন্ধ করে সুস্থ হলাম, তবে নাসিকা নালির সমস্যা থেকে গেল এবং সেটা গা-সহা হয়ে গিয়েছে।
এখন ক্ষুদ্রঋণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলি। যদিও, প্রিয় পাঠক, আপনি ইতিপূর্বে সেটা জেনেছেন। কারণ ৪ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠে বিষয়টি ছাপা হয়েছিল, তবু অতি সংক্ষেপে বলছি। সাংবাদিক ফখরে আলম আমাদের 'হিলারি আদর্শপল্লীর' গল্প শুনিয়েছেন। এটা হচ্ছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মনিহাটি গ্রামের ঋষিপাড়া। ঋষিপাড়া নাম শুনে বোধকরি বুঝতে পেরেছেন পল্লীটির বাসিন্দারা নীচু জাতের দরিদ্র হিন্দু জনগোষ্ঠী। ১৯৯৫ সালের ৩ এপ্রিল গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম দেখতে এসেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি।
ফখরে আলমের লেখাটি থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের ফাঁদে পড়া ঋষিপাড়ার তিন মহিলার দুঃখের পুনর্লিখন করছি। হিলারির আগমন উপলক্ষে নিজ বসতভিটায় পাকা দালান নির্মাণের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক পার্বতী রানীকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছিল। সুদসহ সেই টাকা পরিশোধ করতে পার্বতীকে তাঁর ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন তিনি তিন সন্তানকে নিয়ে গ্রামের পাশে একটি খুপরি ঘরে বাস করছেন। এ জমিটি তাঁর নয়, এটা প্রস্তাবিত সেনাবাহিনীর আবাসন প্রকল্পের এক টুকরো জমি। ময়না ঋষিকেও সে সময় পাকা দালান করার জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছিল। ঋণের কিস্তি না দিতে পেরে ময়না স্বামী-সন্তানসহ চট্টগ্রামে পালিয়ে যান। পরে ফিরে এসে ভিটেমাটি বেঁচে সর্বস্বান্ত হয়ে ঋণ শোধ করেছেন। সাত হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে পারুল মারা যান। গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন পারুলের লাশ দাহ করতে না দেওয়ায় তাঁর স্বামী কার্তিক মুচলেকা দিয়ে স্ত্রীর শেষ সৎকার করেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা উপরিউক্ত তিন মহিলার সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা পড়ে আমার মনে এ প্রশ্নটি হাজির হলো কি সেই মারণাস্ত্র এ ঋণ দেওয়ার পেছনে লুকিয়ে আছে? পড়লাম আর একজন অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সম্পাদিত 'মাইক্রো ক্রেডিট ইন বাংলাদেশ' বইটি। বইটির ৪ নম্বর ক্রোড়পত্রে কয়েকটি ক্ষুদ্রঋণ দাতা প্রতিষ্ঠানের সুদের হিসাব দেওয়া আছে এবং তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। এখন হিসাবটি বলছি। পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিলে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে চার হাজার ৭৫০ টাকা দেয়, ঋণের টাকার শতকরা পাঁচ টাকা হিসাবে ২৫০ টাকা বাধ্যতামূলক সঞ্চয় হিসেবে রেখে দেয় ও শতকরা ১০ টাকা হারে সুদ নেয়।
এরপর ৪৬টি সাপ্তাহিক কিস্তি মারফত গ্রামীণ ব্যাংক ওই ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে পাঁচ হাজার ৫২০ টাকা আদায় করে। বাধ্যতামূলক সঞ্চয় ওই ২৫০ টাকার ওপরে শতকরা ১২ টাকা হিসাবে এক বছরের সুদের পরিমাণ হয় ৩০ টাকা। এ ছাড়া ঋণগ্রহীতাকে সাপ্তাহিক কিস্তির টাকার সঙ্গে ২০ টাকা অতিরিক্ত জমা দিতে হয়, যা ঋণ পরিশোধ অন্তে শতকরা সাড়ে আট টাকা সুদসহ ফেরত দেওয়া হয়। অর্থাৎ হিসাব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক সুদ হিসেবে আদায় করছে ৫৫৭ টাকা, অর্থ সুদের হার ২৬ দশমিক ৬ টাকা। কিন্তু যদি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ঋণগ্রহীতার বসতবাড়ি থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসে ৪৬ বার যাতায়াতের খরচ এবং ঋণের পাসবই, রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও অন্য কাগজপত্রের দাম ঋণগ্রহীতাকে দিতে হয়, যা যোগ করলে দেখা যাবে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক আদায়ী সুদের হার হবে ৩০ দশমিক ৫ টাকা।
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পুঁজিবাদের দরকার দরিদ্রতা এবং সে কারণে এমন প্রক্রিয়ায় ঋণ দেওয়া হয় যেন দরিদ্রতা সহনীয়; কিন্তু বজায় থাকে। সামন্তকালেও একই কারণে দরিদ্রতা দরকার হতো। সামন্তপ্রভুরা চাষিদের কাছ থেকে খাজনা এত বেশি নিংড়ে নিতেন যেন জীবনধারণের জন্য যতটুকু দরকার চাষিরা তার চেয়ে বাড়তি আয় করতে না পারেন। ফ্রান্সিস ফুকুমায়া 'দি এন্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান' বইটিতে পুঁজিবাদ বাঁচিয়ে রাখতে একটি বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব দিয়েছেন যে মানব সভ্যতার ইতিহাস শেষ হয়ে গিয়েছে। এর পর থেকে একমাত্র ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মতাদর্শকে আপন করে সব দেশের মানুষ চিরকাল সুখে বেঁচে থাকবে। দেখা যাচ্ছে ধনতন্ত্রের পেটোয়া কিছু বুদ্ধিজীবী এ তত্ত্বকে বহাল রাখার জন্য নানা ফিকির করছেন। মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রম যার একটি নমুনা। দারিদ্র্যমুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগের অন্তর্ভুক্ত 'মালিকানার নীতি' পার্শ্ব শিরোনামের ১৩ অনুচ্ছেদই যথেষ্ট, যেখানে বলা আছে মালিকানা-ব্যবস্থা নিম্নরূপ হবে_(ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, (খ) সমবায়ী মালিকানা ও (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত ব্যক্তির মালিকানা।
লেখক : আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি

No comments

Powered by Blogger.