উন্নয়ন-বাংলাদেশের শ্রমশক্তি: সমস্যা ও সম্ভাবনা by সালমা খান

মাত্র বছর দুয়েক আগেও দ্রুত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে ১৩টি উদীয়মান দেশের তালিকাভুক্ত করা হলেও (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ২০০৮) সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সে সম্ভাবনা প্রায় হ্রাস পেতে চলেছে।


কৃষি খাতে, বিশেষ করে শস্য উপখাতে প্রবৃদ্ধির হার কম হওয়া, রপ্তানি আয়ের নিম্নমুখিতা (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৯-১০), মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে আমাদের প্রবেশগম্যতা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পাওয়া এবং দেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সংকটের কারণে উত্পাদন ব্যাহত হওয়া এর মূল কারণ। সেই সঙ্গে বিস্ফোরণোন্মুখ জনসংখ্যা, দ্রব্যমূল্যের ক্রম-ঊর্ধ্বমুখিতা এবং জীবনমানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ শ্রমমজুরি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমা লঙ্ঘনে অপারগ করে তুলেছে, যা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিকাশের অন্তরায়।
অন্যদিকে, অর্থনেতিক উন্নয়নে শ্রমশক্তি ও উদ্যোক্তার অব্যাহত প্রয়াস—নারীসহ প্রবাসী শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান হার প্রায় ৭০ লাখে পৌঁছেছে। পোশাকশিল্পে অব্যাহত শ্রমিক বিক্ষোভ মোকাবিলা করেও এই খাতে বিগত অর্থবছরে প্রায় ১২ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে। এসব তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়, এখনই সময় অর্থনীতির বিশেষ সুযোগগুলো ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর। আমাদের মূল সম্পদ সুবিশাল শ্রমশক্তি। প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, ন্যায্য মজুরি ও নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে এদের উন্নয়নবান্ধব করে তোলা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে (২০০৫-০৬) দেখা যায়, দেশে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির সংখ্যা চার কোটি ৯৫ লাখ, যার মধ্যে এক কোটি ১৩ লাখ নারী এবং মোট শ্রমশক্তির ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত। দিনমজুর শ্রেণীতে ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োগকৃত শ্রমিকের হার প্রায় ১২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, অর্থাত্ দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭৮ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমদান করছে। এর মধ্যে তুলনামূলকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীশ্রমিকের আধিক্য লক্ষণীয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কোনো প্রকার শ্রম আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না বিধায় ন্যূনতম মজুরি, গ্রহণযোগ্য কর্মপরিবেশ বা আইনানুগ অন্য কোনো সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগ তাদের নেই। উপরন্তু নারীশ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ অতি সীমিত হওয়ায় তাঁরা মূলত বিনা মজুরিতে পারিবারিক পেশায় শ্রমদান করেন অথবা পুরুষের তিন-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক মজুরিতে অনিয়মিত কৃষিশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক বা গৃহভৃত্য হিসেবে নিয়োজিত থাকেন।
এই শ্রমশক্তিকে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে যথাযথ ভূমিকা পালনের পূর্বশর্তের মূলে রয়েছে প্রশিক্ষণ, ন্যায্য মজুরি ও শ্রমকল্যাণ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ।
প্রশিক্ষণ: দক্ষতাই একজন শ্রমিকের মূলধন। কিন্তু বাংলাদেশের স্থানীয় বা বিদেশগামী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ অতি সীমিত। অধিকাংশ ট্রেডের জন্য দেশে তেমন কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র নেই। বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য বিএমইটির আওতায় কিছু প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকলেও তা মানসম্মত নয় এবং মাত্র সাতটিতে নারীদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং নারী প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য আবাসন সুবিধা সৃষ্টি অপরিহার্য। সেই সঙ্গে দক্ষ প্রশিক্ষক গড়ে তুলতে হবে।
শ্রমমজুরি: যেহেতু আমাদের শ্রমশক্তির সিংহভাগ কৃষি ও অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, সরকারকে প্রথমে এই খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও কর্মঘণ্টা-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে এক সরকারি ইশতেহারের মাধ্যমে কৃষি ও অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের জন্য এক হাজার ৫০০ টাকা হারে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ছিল সম্পূর্ণ অবাস্তব। কারণ বর্তমানে একজন দিনমজুর ন্যূনতম দৈনিক ২০০ টাকা হারে কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে সব কৃষিশ্রমিক ও কায়িক শ্রমিকের দৈনিক মজুরির হার সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা ধার্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বলা যায়, দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নির্ধারিত মজুরি বা কর্মঘণ্টা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই যুক্তি আংশিক মেনে নিয়েও বলা যায়, এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা ও জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষিশ্রমিক ও কায়িক শ্রমিকদের পক্ষে ন্যূনতম মজুরি দাবির বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সবচেয়ে নিগৃহীত ও বৈষম্যের শিকার গৃহপরিচারিকারা, যার ৯৯ শতাংশ নারী ও শিশু। নারী গৃহপরিচারিকার ক্ষেত্রে আহার ও বাসস্থানসহ ন্যূনতম মজুরি এক হাজার ৫০০ টাকা ধার্য করা যায়। সেই সঙ্গে গৃহকর্মে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে এসব নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব।
আনুষ্ঠানিক খাতের শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা ও করপোরেশনগুলোয় কর্মরত শ্রমিকেরা প্রযোজ্য সরকারি স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন, যা অন্যত্র সরকারের অনুরূপ পদের কাজে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সরকারি অনুদান ও ভর্তুকির কারণে অবস্থার লাভ-ক্ষতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প। সেখানে বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে, যার ৮০ শতাংশ নারী। সাম্প্রতিককালে পোশাক শিল্পে অব্যাহত শ্রমিক বিক্ষোভ, কারখানা ভাঙচুর, লুটপাট ইত্যাদি এই অপার সম্ভাবনাময় শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এর বিভিন্ন কারণ থাকলেও মূলত মজুরির হার ও মজুরি প্রদানে অনিয়মিতকেই দায়ী করা হচ্ছে। শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষ থেকে ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে। আর বিপরীতে সরকারি সুপারিশ রয়েছে মাত্র এক হাজার ৬৬৫ টাকা।
এ ক্ষেত্রে বলা যায়, উভয় মজুরি হারই কিছুটা অবাস্তব। বর্তমান বাজারে শিল্পশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি এক হাজার ৬৬৫ টাকা, যা দ্রব্যমূল্য ও জীবনমানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের দাবীকৃত অদক্ষ ও শিক্ষানবিশ শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা, যা সর্বমোট সাতটি গ্রেডের মধ্যে প্রথম গ্রেডের জন্য, এটা মালিক পক্ষের দ্বারা গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কারণ সে ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে উত্তরোত্তর গ্রেডে হাজিরা বোনাস, উত্পাদন বোনাস, ওভারটাইম, যাতায়াত ভাড়া ইত্যাদিসহ গড় মজুরি যে অঙ্কের কোঠায় দাঁড়াবে, তাতে অধিকাংশ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে বাস্তবসম্মত সমঝোতায় আসতে হবে। পোশাক শিল্পে সম্প্রতি নারীশ্রমিকের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে কিছু কিছু অঞ্চলে উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। সে জন্য শিল্পমালিকদের যেমন শ্রমিক প্রণোদনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি এই শিল্পকে রক্ষা করার জন্য মালিক পক্ষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে বহিরাগত অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দুই পক্ষের আন্তরিকতাই পরস্পরের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।
শ্রমিক-কল্যাণ: বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর (সংশোধিত) আওতায় ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট ১৯৬৫-এ মূলত কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, দেশের সব শিল্পকারখানার তুলনায় তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানাগুলো আমদানিকারকদের দ্বারা আরোপিত শর্তসাপেক্ষে আধুনিক ও উন্নত মানের তৈরি হলেও বেশ কিছু কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে চলেছে, যাতে শ্রমিকের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে।
এতে প্রমাণিত হয় যে এসব কারখানা দৃশ্যত আধুনিক হলেও এদের আইনানুগ অগ্নিপ্রতিরোধক ও নির্বাপক ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিবীক্ষণ আরও নিবিড় ও জোরদার করতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানা বা সংস্থায় অধিকাংশ সময় নারীশ্রমিককে তাঁদের প্রাপ্য চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পূর্ণ বেতনে দেওয়া হয় না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এই ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রত্যেক নারীশ্রমিক যাতে পূর্ণ বেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করতে পারেন, সে জন্য মালিক পক্ষকে দায়বদ্ধ করতে হবে।
আইনানুযায়ী নারীশ্রমিক থাকা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। যেসব নারী-পুরুষ প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কায়িক শ্রমে নিয়োজিত, ভারী বোঝা বহনের কারণে তাঁদের স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয়, সে কারণে অনেকেরই কর্মজীবন হ্রাস পায় বা তাঁরা পঙ্গুত্বের শিকার হন। ফ্যাক্টরিস রুলস, ১৯৭৯-এর ধারা ৪৮(১) অনুযায়ী, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ সর্বাধিক ৬৮ পাউন্ড এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারী সর্বাধিক ৫০ পাউন্ড ওজন তোলা বা বহন করতে পারেন। কুলি-মজুর শ্রেণীর ক্ষেত্রে এ আইন মানা হয় না এবং শ্রমিকদেরও এই সীমা সম্বন্ধে অবহিত করা হয় না। এই ব্যাপারে কায়িক শ্রমিক ও জনগণকে সচেতন করা প্রয়োজন।
একটি উন্নয়নমুখী উদীয়মান রাষ্ট্র হওয়ার যে সুপ্ত সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে, তা বাস্তবায়ন সম্ভব শুধু একটি দক্ষ, সুশৃঙ্খল উন্নয়নবান্ধব শ্রমশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে; যার সম্মিলিত দায়িত্ব সরকার, মালিক ও শ্রমিকের।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.