পরিবেশ-বন্যপ্রাণী, বাণিজ্য-বাহাদুরি ও বিপন্নতা by পাভেল পার্থ

বনবিদ্যা ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত বাণিজ্য পরিসরে বন্যপ্রাণীর সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষকে ট্রফি নামে চিহ্নিত করা হয়। আর এ ট্রফিকে ঘিরেই দুনিয়াজুড়ে রয়েছে অন্যায় ও খুনখারাবির এক প্রশ্নহীন করপোরেট বাণিজ্য। পরিবেশগত ও জলবায়ু বিপর্যয়, প্রাকৃতিক বন, জলাভূমি ও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্যহীনতা বা খাদ্যাভাবই নয়,

বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের পাচার এবং বাণিজ্যও বনপ্রাণবৈচিত্র্যের বিপন্ন হয়ে ওঠা এবং বিলুপ্তির কারণ। চলতি দুনিয়ায় অস্ত্র এবং মাদকের পরপরই বন্যপ্রাণী ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের পাচার হচ্ছে এক সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চোরাচালান এবং করপোরেট বাণিজ্যের অংশ। আর এই পাচারের ফলে বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের কেবল বিলুপ্তি এবং বিপন্নতাই যে তৈরি হচ্ছে তা নয়, একই সঙ্গে এসবের ওপর নির্ভরশীল জীবন-জীবিকাও হয়ে পড়ছে সংকটাপন্ন। খাদ্য, ঔষধি, চিকিৎসা, বিনোদন, শখ বা স্রেফ বাহাদুরি দেখানোর জন্যই বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের এই পাচার ও বাণিজ্য টিকে আছে। একটা সময় বিপুল পরিমাণে সোনাব্যাঙের পা পাচার ও রফতানি হয়েছে। বাঘ, হরিণসহ সুন্দরবন থেকে প্রতিনিয়ত বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ পাচার হয়। টাঙ্গাইল-গাজীপুরের শালবন এলাকার মান্দি নারীরা শালবনে এখন তেমন কোনো বনআলু কি ঔষধি উদ্ভিদ খুঁজে পান না। বিভিন্ন কোম্পানি এবং বাঙালি বহিরাগত পুরুষরা এসে বস্তা ভরে সেসব তুলে নিয়ে গেছে। 'ম্যাগনেট ব্যবসার' কথা বলে পেঁচাও পাচার হয়েছে। গন্ধগোকুল, ভালুক, বনরুই, গুইসাপ, কুমির, তক্ষক, জোঁক, পিঁপড়ার ডিম, সাপ, বিভিন্ন পাখি, বাঘ, হরিণ, বেজি, শুশুক, হাতির মতো বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য ও পাচার নিত্যদিনের ঘটনা। সাপকেন্দ্রিক মাঙতা নারীদের পেশাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে বিষ ব্যবসায় সাপের বাণিজ্যিক পাচারের ফলে।
বন্যপ্রাণীর বাণিজ্যিক পাচার ও বাণিজ্য নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা দৃঢ় না হলেও এসব বাণিজ্য ও পাচারের কিছু খবরাখবর মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ২ জুলাই ২০১০ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্র্জািতক বিমানবন্দর থেকে ময়না, টিয়া, লাভবার্ডসহ বিপুলসংখ্যক পাখি পাচারের সময় বিমান কর্তৃপক্ষ পাচারটি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তানের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিমানে করে বাংলাদেশের এসব দুর্লভ ও বিপন্ন পাখি পাকিস্তানে পাচার করা হচ্ছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১০ থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিপন্ন প্রজাতির প্রায় ১,১৪০টি কচ্ছপের চালান আটক করেছিল সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ দৈনিক সমকালের পেছনের পাতায় পাচার হওয়া কচ্ছপের একটি বাচ্চা হাতে একজন থাই কর্মকর্তার ছবি ছাপানো হয়েছিল। ৫ আগস্ট ২০১১ বেনাপোল সীমান্ত থেকে ২০০ জোড়া দেশি দুর্লভ প্রজাতির পাখির একটি চালান আটক করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, ৭.৮.২০১১)। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত 'বনে বিরল, তবে বাজারে বিকায়' শিরোনামের প্রতিবেদন বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীকে ঘিরে এক অন্যায় বাণিজ্য-বাহাদুরির রূপ দেখা গেছে (৭.৮.২০১১)। দেশের বিলুপ্তপ্রায় ভালুক, গন্ধগোকুল, লামচিতা, বনবিড়াল, মেছোবাঘ, বাঘ, হরিণ, অজগর, বেজি, পাখি, হাঙরসহ প্রায় সব ধরনের বন্যপ্রাণীই বিকিকিনি হচ্ছে দেশে ও দেশের বাইরে। কখনও জীবন্ত, কখনওবা ট্রফি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে বন্যপ্রাণীর শরীরের কোনো না কোনো অংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শোনা যাচ্ছে তক্ষক ও গুইসাপ নির্বিচারে হত্যা ও পাচারের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে চোরাকারবারি চক্র।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ঔপনিবেশিক বন আইন ১৯২৭ এবং বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০ অনুযায়ী বন্যপ্রাণীর পাচার ও বাণিজ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য এবং আইনত নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ে 'আবদ্ধ প্রাণী, বন্যজন্তু, প্রাণিজ বস্তু, ট্রফি এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী সম্পদের ব্যবসা' শীর্ষক অধ্যায়ের ৩৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিই চিফ ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন বা তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা কর্তৃক অনুমতি গ্রহণ না করে তফসিল-১ ও ২-এর অন্তর্ভুক্ত বন্যজন্তু, প্রাণিজ বস্তু, মাংস, ট্রফি বা অসম্পূর্ণ ট্রফি অথবা নির্ধারিত প্রজাতির উদ্ভিদ বা এর অংশ বা তা থেকে উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারবে না। বন্যপ্রাণী আইন ২০১০-এর ১১ নম্বর ধারায় বন্যপ্রাণী, ট্রফি ও বন্যজন্তুর মাংসকে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি কার্যক্রমের সভায় আন্তর্র্জািতক বাণিজ্যের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের ধ্বংসের আশঙ্কার বিষয়টি প্রথম উত্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ২১টি দেশের স্বাক্ষরদানের মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত সম্মেলন ১৯৭৩ সনদ। ১৯৭৫ সাল থেকে কার্যকর এ আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থনকারী দেশের সংখ্যা ১৬৯। এ সনদের প্রধান উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদকুলের অতিমাত্রায় ব্যবহার রোধ করা। সারা দুনিয়ার প্রায় পাঁচ হাজার বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী এবং ২৮ হাজার বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতিকে এই সনদের তালিকায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর এই সনদ অনুমোদন করে এবং ১৯৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে এই সনদটি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হয়।
রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ থাকা সত্ত্বেও কেন দেশে বন্যপ্রাণী বাণিজ্য থামানো যাচ্ছে না? আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও বন্যপ্রাণী আইন ২০১০-এর ২৯ ধারামতে, লাইসেন্স ছাড়া বন্যপ্রাণী ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চাষ বা লালন-পালন নিষিদ্ধ, কিন্তু অনুমতিসাপেক্ষে বন্যপ্রাণী ও বন্যপ্রাণীর ট্রফি কি মাংসের ব্যবসা করা সম্ভব। আইনের এ ধরনের অস্পষ্ট ও সংঘর্ষমূলক ধারার কারণে অনেকে চালিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর অন্যায় বাণিজ্য। বন্যপ্রাণীর বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো অনুমোদন, 'বৈধতা' কি 'অবৈধতা' থাকতে পারে না। এটি আইনগতভাবে সম্পূর্ণত নিষিদ্ধ করা জরুরি। বন বিভাগ, প্রশাসন, সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আরও দায়িত্বসচেতন, দক্ষ ও প্রাণবৈচিত্র্যবান্ধব করে গড়ে তোলা উচিত। কোনো বাস্তুসংস্থান ও প্রতিবেশ থেকে একটি বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ নিশ্চিহ্ন হলে সেখানকার বিরাজমান বাস্তুশৃঙ্খল চুরমার হয়ে যায়। যার প্রভাব সরাসরি মানুষের জীবন, জীবিকা ও সমাজে পড়তে বাধ্য। বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ কি মানুষ সবাইকে ঘিরে সবাইকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এক জটিল সংসার। কেবল বাণিজ্য-বাহাদুরির জালে কাউকে আটকে ফেলে, হত্যা করে বা নির্দয়ভাবে বেচাকেনা করে এ সংসার চলতে পারে না। আশা করি সব ধরনের বাণিজ্য-বাহাদুরিকে প্রশ্ন করে রাষ্ট্র বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের বিপন্ন জীবন সুরক্ষায় আপন শিরদাঁড়ায় উঠে দাঁড়াবে। বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রচনা করবে বন্যপ্রাণী-ন্যায়পরায়ণতার এক দুর্বিনীত আখ্যান।

পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.