চারুশিল্প-নীলিমা ও নৈরাজ্যের ছোটগল্প by জাফরিন গুলশান

১৫২×৩৬৬ সেন্টিমিটার আয়তনের বিশাল চিত্রপটে মেঘের খুব কাছাকাছি ভূমিতে বাতাস বইছে। একজন নগ্ন পুরুষ ও একজন নগ্ন নারী কাছাকাছি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঁশিতে সুর তুলছে। হলুদ ধূসর ভূমিতে ৩১টি প্রতিকৃতি। গৌতম বুদ্ধ, শেক্সপিয়ার, আব্রাহাম লিংকন, আইনস্টাইন, কার্লমার্ক্স, মাও সে-তুং, মাদার তেরেসা প্রমুখ অমরকীর্তিতে বেঁচে থাকা
মানুষেরা। যাঁদের সুরের সঙ্গে সুর মেলানোর গল্প বলছেন ভারতীয় বাঙালি শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে ‘নীলিমা ও নৈরাজ্য’ শীর্ষক একক প্রদর্শনীর ‘দ্য টিউন’ (২০১০) শিরোনামের ছবির ভূমিতে কতগুলো গর্ত ভেদ করে বেরিয়েছে শুকনো গাছের বাকল। মেঘের রং সাদাকে ঘিরে মিলেমিশে একাকার নীলের সঙ্গে কিছুুটা বেগুনি কিংবা ধূসর সবুজাভ রং। একধরনের ‘স্যুররিয়াল’ আবহে গল্প বলা। স্যুররিয়াল আবহ শিল্পী শুভাপ্রসন্নের কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য আকারে এই প্রদর্শনীতে উপস্থিত। শিল্পীর শিল্পকর্ম একাধারে বক্তব্যনির্ভর ও চরিত্রগুলোর দেহভঙ্গিমা গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রপটের বড় অংশজুড়ে ছবির মূল চরিত্রের উপস্থিতি বাংলা অঞ্চলের লোকঐতিহ্যবাহী চিত্রকৌশলের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। শুভাপ্রসন্নের চিত্র অনেক বেশি অভিব্যক্তিময়। ‘আইকন’ সিরিজের কাজগুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে বিবিধ মুখের, চোখের ভঙ্গিমার অভিব্যক্তিতে। দর্শকের সঙ্গে যেন কথা বলে। পিঁপড়া, মৌমাছি, কাক, মাছ, পেঁচা ইত্যাদি সিরিজ আকারে ছবির বিষয় হিসেবে এসেছে বারবার। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রাণীকে বিষয় হিসেবে ব্যবহার করছেন। ছোট ছোট এসব প্রাণীর দেহভঙ্গিমা এবং চোখের অভিব্যক্তি শিল্পীর মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করে। ছোটগল্পের আঙ্গিকে রবিঠাকুরের ভাষায়, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভারতের সমকালীন প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পবলয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী।
তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একজন বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তাঁর। তাঁর শিল্পকর্মে ধ্রুপদি ভারতীয় চিত্রকর্মের আঙ্গিক, সমকালীন বিষয়বাস্তবতা, সংস্কৃতি, জনপদের উপস্থিতির সঙ্গে চিন্তা ও পরিকল্পনার আধুনিকায়ন বিদ্যমান। ড্রয়িংয়ের প্রতি ভালোবাসা শিল্পীর কাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। অনেক ধরনের রেখার মাধ্যমে টোন সৃষ্টি, ড্রইংয়ের সাবলীল উপস্থিতি তাঁর চরিত্র নির্মাণের আকর্ষণীয় পন্থা। প্রায় প্রতিটি চিত্রপটে অনেকগুলো রঙের তলের ব্যবহার রয়েছে এবং সেসব তলের প্রায় বিস্মৃত উপস্থিতি দারুণ মুনশিয়ানার সঙ্গে সুকৌশলে সব কাজের নান্দনিক অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে সুপ্রকাশিত। ‘দ্য শ্যাডো’ শিরোনামের শিল্পকর্মের মূল বিষয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একটি আরামকেদারায় বসে বই পড়ছেন, পেছনে পাতাবিহীন বৃক্ষের ছায়া। বড় ভূমিতলের স্থানে আকাশে চাঁদ। ছবিতে ড্রপোরির দক্ষতা ইউরোপীয় ঘরানার, ধ্রুপদি ঘরানার। হলুদাভ ভূমি ও বৃক্ষের ছায়া, একধরনের বাতাসের উপস্থিতি, পেছনে আকাশ ও চাঁদের যে রং ব্যবহূত হয়েছে, তাতে পুরো ছবির ভেতর ঐশ্বরিক অনুভূতির উপস্থিতি। কবিগুরুর ‘ছায়া’ হয়তোবা বাঙালির জীবনে এভাবেই দীর্ঘতর হয়ে আছে। ‘দ্য গোট’ ছবি পুরো চিত্রপটে গর্ভবতী একটি ছাগলের সপ্রতিভ উপস্থিতি। সব কাজের মতো এটিও মিক্স মাধ্যমে করা শিল্পকর্ম। রং ব্যবহারে মনে হয়েছে, শিল্পী গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর ছবির গল্প ও চরিত্রের কম্পোজিশনের ওপর। সাদা, হলুদ, নীল, কালো, সবুজ, ধূসর ইত্যাদি রং বিভিন্ন তল ভেদ করে মূল গল্পের চরিত্র বিনির্মাণ করেছে। শহরকে দেখেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। সুউচ্চ অট্টালিকার নিচে অগুনতি টিনের একচালা বাড়ির উপস্থিতি বর্তমান শ্রেণীবৈষম্যের সমাজব্যবস্থার প্রকাশ। এখানেও তিনি এক ধোঁয়াশার সময়কে চিত্রায়ণ করেছেন।
শিল্পী শুভাপ্রসন্ন এখন বয়োজ্যেষ্ঠ একজন চিত্রশিল্পী। কিন্তু তাঁর শিল্পগুকর্ম অনেক বেশি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। বুদ্ধিমান শিল্পী সুপরিকল্পিতভাবে জানেন, কীভাবে শিল্পবলয়ে অধিষ্ঠিত করতে হয় নিজেকে। অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পকর্ম কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যে তা শুভাপ্রসন্নেরই। প্রদর্শনী ২৪ মার্চ পর্যন্ত খোলা থাকবে বাংলাদেশের শিল্পরসিকদের জন্য।

শিল্পী শুভাপ্রসন্ন— জন্ম: ১৯৪৭ সালে কলকাতায়। রবীন্দ্রভারতী থেকে তিনি ১৯৬৯ সালে এবিএফএ করেন। ৫০টির অধিক এককচিত্রকর্ম প্রদর্শনী করেছেন ভারতে ও বাইরে। বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন নিয়মিত। বই লিখেছেন শিল্পকলা ও সাহিত্য সম্পর্কে এবং বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। তিনি এআইএফসিএস অ্যাওয়ার্ড, স্টেট এলকেএ অ্যাওয়ার্ড, বিরলা একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পদক পেয়েছেন। দেশে ও দেশের বাইরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর কাজ সংগৃহীত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.