উত্পাদনমূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ দরকারঃ টাকার প্রবাহ বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়

দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান স্থবিরতা যে কাটছে না, সেটা সহজেই চোখে পড়ে। তিন বছর ধরে বিনিয়োগে মন্দাবস্থা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সৃষ্ট পরিবেশে বিনিয়োগ থমকে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাচিত সরকারের এক বছর ধরে তেমনি অবস্থা বিরাজ করা আশ্চর্যজনকই বটে।
মুখে যে যাই বলুক না কেন, বিনিয়োগমন্দা কাটাতে সরকারের সাফল্য বাস্তবে প্রতিফলিত নয়। অবকাঠামোগত সঙ্কট সমাধানে সরকারের ব্যর্থতাই এজন্য দায়ী, সেটা পরিষ্কার।

জ্বালানি ছাড়া যে উত্পাদন স্বাভাবিক হওয়াার নয়, সেটা কে অস্বীকার করবে। আর বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সঙ্কট নতুন দূরে থাক, পুরনো উত্পাদন ক্ষেত্রগুলোতেও অচলাবস্থা ত্বরান্বিত করছে। বহু শিল্প-কারখানায় উত্পাদন মার খাচ্ছে। অনেকগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চাহিদামত জ্বালানি সরবরাহ না পাওয়ার কারণে। ব্যবসায়ীদের আস্থাও ফিরে আসছে না। নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতার ফলে জমে ওঠা অলস অর্থ ক্রমবর্ধমান হারে শেয়ারবাজারে যাচ্ছে। এতে করে সেখানকার পরিস্থিতিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আসল জায়গায় হাত না দিয়ে ঝোপঝাড় পেটানোর মতো সরকারি পদক্ষেপে পরিস্থিতি উন্নতির আশা জাগাতে পারছে না। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য আবারও বাড়তে শুরু করেছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির ফল উল্টো হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা ও শিল্প খাতে টাকার সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণা কোনো কাজে আসবে মনে হয় না। এখানে গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কটের সমাধান কীভাবে হবে, সেটা মোটেই গুরুত্ব পায়নি। অবস্থা এমন থাকলে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে দেয়া অতিরিক্ত ঋণ সুফল বয়ে না এনে কুঋণের পরিমাণ বাড়াবে—এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। বিনিয়োগের পথে বিরাজমান বাধাগুলো দূর করতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলেও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিশাল পরিমাণের জাতীয় বাজেট এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে সরকারের সফলতার দাবি এখনই মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করেছে। পিপিপি নামে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের বিশেষ বরাদ্দ ফলাও প্রচার পেলেও তার কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না। বাস্তবায়ন সমস্যার কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনার ২ হাজার কোটি টাকা ছাঁটাই হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এডিবির বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত না হলেও অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে সরকারের ঋণের পরিমাণ গত বছর নেয়া ১ হাজার ৩৪৯ কোটি ১৬ লাখ টাকার স্থলে ৪ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে চলার পরিণতি কী হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
দেশে অলস টাকার পাহাড় জমে উঠলেও বিনিয়োগ না হওয়া নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়াকে সফলতা হিসেবে তুলে ধরা হলেও এর পেছনে সরকারের ভূমিকা নেই বললেই চলে। বৈদেশিক মুদ্রার বিপুল মজুত সত্ত্বেও অর্থনীতির গতি না পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। সরকার কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সক্ষম হয়নি, তার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না—এটাই হয়ে উঠেছে উদ্বেগের কারণ। স্থায়ী বিদ্যুত্ ও গ্যাস সঙ্কটের পাশাপাশি আমদানিচিত্র থেকেও সেটা প্রমাণ হয়। গত অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসের তুলনায় এবছর একই সময়কালে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ। অর্থাত্ পরিস্থিতি পেছনে হাঁটতে শুরু করেছে।
এ অবস্থায় সরকার অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা যদি উত্পাদন খাতের পরিবর্তে অনুত্পাদন খাতে বা ভোক্তা খাতে ব্যয় হয়, তবে বিরাজমান মূল্যস্ফীতি আরও গতিলাভ করবে সন্দেহ নেই। এই বিপদ এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, বিশেষ করে বিদ্যুত্ ও গ্যাস সরবরাহ অগ্রাধিকার দাবি করে। অথচ গত এক বছর এ খাতে উল্লেখ করার মতো কিছু হয়নি। ফলে শিল্প খাতে অগ্রগতি নেই। কৃষির অবস্থাও আশাব্যঞ্জক বলা যাবে না। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক ছাড়াও বিদ্যুত্ সঙ্কটের কারণে সেচ ব্যাহত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠবে। এর ওপর কৃষিঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি তখন কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে উঠতে পারে। খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে মহাজোট সরকারের ভবিষ্যত্ই আশঙ্কাজনক হয়ে উঠতে পারে। অতএব, বিনিয়োগ পরিস্থিতির দিকে বাস্তবসম্মত দৃষ্টি দেয়া খুবই জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.