ভারত-জনমত শাসন করছেন আন্না হাজারে by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

শাসক দল যখন ক্ষমতায় বুঁদ হয়ে থাকে তখন রাজনৈতিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে তেমন আমল দেয় না। ২০১১ সালে সিপিএম বুঝতে পারেনি সাধারণ নির্বাচনে ভারতের দুটি রাজ্যে এভাবে ধস নামবে। ওই ২০১১ সালে দিলি্লর ইউপিএ সরকারও আঁচ করতে পারেনি যে, বিরোধী বিজেপি এতদিনে যা পারল না গুজরাটের গ্রামের এক বৃদ্ধ আন্না হাজারে কয়েক

দিনের মধ্যেই দেশজুড়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটা প্রবল ঝড় তুলতে কীভাবে সক্ষম হলেন? ১৯ আগস্টে প্রতিবেদন যখন লিখছি তখন পুরো ভারতের গণমাধ্যমে শুধু আন্না আর আন্না। এই যে গত ১৬ আগস্ট হাজার হাজার লোক তার সমর্থনে দিলি্লতে জমায়েত হয়েছেন, ১৪৪ ধারা অমান্য করে জেলে গেছেন, তাদের কাউকে তিনি ডাকেননি। তার সমর্থনে নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব থেকে সমাজ ব্যক্তিত্বরা। সাবেক পুলিশ অফিসার ও বর্তমানে বিশিষ্ট নারীবাদী সক্রিয় কর্মী কিরণ বেদি প্রমুখ। আর যারা এসেছেন তার সমর্থনে তারা বিভিন্ন পেশাদার মানুষ, অধিকাংশই ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতী। কিন্তু তাদের অনেকেই নিজেরা পয়সা খরচ করে দূর-দূরান্ত থেকে চলে এসেছেন আন্নাকে সমর্থন দিতে।
মনমোহন সিংকে শিখণ্ডি খাড়া করে ইউপিএ সরকারের তিন-চারজনই বর্তমানে সরকার চালাচ্ছেন। রাহুল গান্ধী দেশজোড়া এই বিক্ষোভ আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন না। তিনি উত্তর প্রদেশের কৃষক আন্দোলন নিয়েই ব্যস্ত। সোনিয়া গান্ধী অসুস্থ হয়ে আমেরিকায়। আত্মম্ভরি শিক্ষামন্ত্রী সিব্বাল আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমই এখন নেতা। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে প্রথম দিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এখন তার আবার ডাক পড়েছে। কয়েক মাস আগে বাবা রামদেব দিলি্লতে এসে কালো টাকা উদ্ধারের দাবিতে অনশনে বসেছিলেন। তারপর গভীর রাতে পুলিশ পাঠিয়ে ঘুমন্ত আন্দোলনকারীদের নির্মমভাবে মারতে মারতে হটিয়ে দেয়। পুলিশের লাঠি দেখে ভয় পেয়ে রামদেব মহিলার পোশাক পরে পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাকে দেরাদুনে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রামদেব অনেকদিন হাসপাতালে ছিলেন। রামদেবের আন্দোলন এভাবে ভেঙে দেওয়াকে সরকারের জয় বলে ঘোষণা করেন চিদাম্বরম ও সিব্বনরা। তাই আন্না হাজারের আন্দোলনও তারা লাঠি দিয়ে ভেঙে দেবেন ঠিক করেন। ১৬ আগস্ট আন্না অনশনে বসার আগেই আন্নাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে তিহার জেলে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অনশন শুরু করেন।
১৬ আগস্ট অনশনের জায়গায় জমায়েত হওয়া আরও কয়েকশ' ব্যক্তি কারাবরণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন কিরণ বেদি। কিন্তু অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। হাজার হাজার মানুষ তিহার জেলের গেটের সামনে এসে জড় হচ্ছে দেখে সরকার রাতারাতি জেল বদলায়। আন্নাকে ৭ দিনের হাজতবাসের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। দু'ঘণ্টার মধ্যে সে আদেশ বাতিল করে আন্নাকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার হুকুম হয়। আন্না বলেন, আমাকে অনশনে বসতে না দিলে আমি তিহার জেল থেকে বেরোবো না। আবার কিছুক্ষণ পর সরকারি আদেশ আসে রামলীলা ময়দানে আপনি ১৫ দিনের জন্য অনশনে বসতে পারেন। এটাই তো চাইছিলেন আন্না। রামলীলা ময়দানে রাতারাতি মঞ্চ তৈরি করে আন্নার অনশন আন্দোলন শুরু হয়। ১৯ আগস্ট থেকে এই রামলীলা ময়দান থেকে ভারতের জনমতকে শাসন করছেন বৃদ্ধ আন্না হাজারে। কয়েক মাস আগেও সাধারণ মানুষ তার নাম শোনেননি। তিনি তার রাজ্য গুজরাটে সমাজসেবার কাজে পদ্মভূষণ সম্মান পেয়েছেন। গুজরাটেও অনেকবার অনশন আন্দোলন করেছেন; কিন্তু গণমাধ্যম এতদিন তাকে প্রচারের আলোয় আনেনি। তিনি এখন পৃথিবীর সব সংবাদপত্রের শিরোনাম। সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো দেখাচ্ছে কী বিপুল পরিমাণ মানুষ তার এ আন্দোলনে শামিল হয়েছে। স্বাধীনতার পর অরাজনৈতিক মানুষের এত বড় আন্দোলন আর ভারতবর্ষে হয়নি। কী পরিণতি হবে এই আন্দোলনের? আন্দোলনের যেসব সমাধানের জন্য কংগ্রেস নেতারা এতদিন চেষ্টা করেছেন বা চেষ্টা করবেন বলে ভাবছেন তা হলো_ ১. কিছুদিন পর যখন ভিড় পাতলা হয়ে যাবে এং আন্না অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়বেন তখন তাকে পুলিশ দিয়ে জোর করে তুলে হাসপাতালে ভর্তি করা। এতে রামলীলা ময়দানের জমায়েত ভেঙে যাবে।
২. আন্নার আন্দোলনের পেছনে আমেরিকার মদদ আছে বলে আমেরিকাবিরোধী ভারতীয় জনগণকে আন্নার আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এই প্রচার হয়েছিল। আমেরিকা তার প্রতিবাদ করছে।
৩. আন্না হাজারে ও তার সহযোগীরা দুর্নীতিপরায়ণ বলে প্রচার করা। এ প্রচার শুরু হয়ে গেছে। উদ্দেশ্য, কোনো অপপ্রচার ছড়িয়ে আন্না সমর্থকদের মধ্যে বিভাজন ছড়িয়ে দেওয়া।
রামদেবের অনশনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস এটা খুব সাফল্যের সঙ্গে করেছিল। রামদেব সাম্প্রদায়িক শক্তি আর এসএস ও বিজেপির মদদপুষ্ট এটি প্রচার করেছিল তারা। আন্না হাজারের সঙ্গে শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর দেখা করে গেছেন যিনি একজন বিখ্যাত হিন্দু ধর্মগুরু, যদিও তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন।
৪. সরকারের সমর্থক গণমাধ্যমগুলো প্রচার করছে অনশন করে আন্না সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করছেন। দ্বিতীয়ত, সরকার লোকপাল বিলের ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থান নিয়েছেন। কারণ কোনো আইন খসড়া করা, গ্রহণ করা, সংশোধনী আনা_ এসব কিছুরই অধিকার একমাত্র সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। আন্না নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসে তার বক্তব্য বলুন। সংসদে অনির্বাচিত-অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংসদ কী করবে, না করবে তা বলার অধিকার নেই।
অর্থাৎ গণতন্ত্রকে ইউপিএ সরকার সংসদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। সেখানে ভোটের জোরেই সবকিছু ঠিক হবে। ইদানীং ভারতীয় সংসদের অধিবেশন বসলে এমন চেঁচামেচি হয়, সেখানে কোনো কাজ হয় না। প্রতিবাদ-চেঁচামেচির জোরে সংসদে এ মুহূর্তে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিল আটকে আছে। যদিও এর মধ্যেই সংসদ এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৮ আগস্ট রাজ্যসভা কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র সেনকে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের দায়ে ইমপিচ করে এবং দীর্ঘ বিতর্ক শেষে ১৮৯-১৭ ভোটে বিচারপতি সেনকে আপাত দোষী বলে প্রতিপন্ন করা হয়। এখন লোকসভা এ অভিযোগগুলো আবার খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বিচারপতি সেনকে রাজ্যসভায় ডেকে এনে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, লোকসভাতেও তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম ইমপিচমেন্ট হলো। এর আগে ব্রিটিশ আসার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে লর্ড ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের ইমপিচমেন্ট হয়েছিল; কিন্তু ভারতে নয়- ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে। দুঃখের বিষয়, ভারতের প্রথম ইমপিচমেন্টটা হলো একজন বাঙালি বিচারপতির বিরুদ্ধে এর আগে দক্ষিণ ভারতের এক বিচারপতির ইমপিচমেন্ট শুরু হয়েছিল, কিন্তু দক্ষিণের এমপিরা দক্ষিণ ভারতের কোনো বিচারপতিকে কলঙ্কিত করতে চাননি বলে তারা একযোগে সংসদের অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি না হওয়ায় ইমপিচমেন্টের প্রচেষ্টা পরিত্যক্ত হয়।
আন্না হাজারের অনশনের ব্যাপারে ইউপিএর শরিক দলগুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। এখন ইউপিএর অন্যতম প্রধান শরিক তৃণমূল চুপচাপ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা এখন ঢাকা সফরের উদ্যোগ-আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। তিনি এখন দুটি ব্যাপারে খুব তৎপরতা দেখাচ্ছেন। সিপিএম আসলে যেসব সিপিএম নেতা ও কর্মী তৃণমূল কর্মীদের ওপর অত্যাচার ও হামলা চালিয়েছিলেন পুলিশ এখন তাদের ধরে তদন্ত করেছে। ধরা পড়েছে সিপিএম মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। অভিযোগ, তিনি নিজে অথবা তার সাগরেদরা তৃণমূল কর্মীদের অপহরণ করে গুম-খুন করে মাটিতে পুঁতে রেখে দিয়েছিলেন। মাটি খুঁড়ে সেসব কঙ্কাল বের করা হয়েছে। তাদের ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, ওগুলো নিখোঁজ তৃণমূল কর্মীর কঙ্কাল। সুশান্ত ঘোষ খুনের দায়ে গ্রেফতার হয়ে পুলিশ হেফাজতে আছেন। এ নিয়ে তুমুল বিক্ষোভ সিপিএম মহলে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একে বলছেন, 'তৃণমূলের প্রতিহিংসা।' তিনি সুশান্তকে অভয় দিয়েছেন। ভয় নেই। তোমার সঙ্গে আছি।
আর মমতা আছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ২২ শ্রাবণ মমতা পরপর দু'দিন ছুটি দিয়েছেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেজেছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। মমতা বাংলাদেশে যাচ্ছেন ভারত-বাংলা রবীন্দ্রচর্চার ধারা সুদৃঢ় করতে।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.