স্মরণ- জাতীয় শিক্ষক দিবস ও শহীদ জিয়া by অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান


মানুষকে শিক্ষার আলো দিতে পারলে সে নিজেই খুঁজে নেবে তার বাঁচার পথ, এজন্য সরকারকে ভাবতে হবে না— একথা বিশ্বাস করতেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাই তিনি বাংলাদেশের মানুষকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেন।
দেশের বিপুল মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত বলেই তারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত, কলহপ্রবণ, স্বাস্থ্যহীন, কর্মবিমুখ ও হীনমন্যতায় ভোগে। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করেই শিক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছিলেন।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার শতকরা ৯০ ভাগই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। অথচ সরকারি বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় পাহাড়প্রমাণ বৈষম্য। এমনকি শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে যেমন ছিল না কোনো চাকরিবিধি, তেমনি ছিল না কোনো বেতন স্কেল। শিক্ষক-কর্মচারীদের পেশাগত মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অঙ্গীকার করেছিলেন। তাই তিনি ১৯৮০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরিবিধি কার্যকর করেন এবং জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারি কোষাগার থেকে প্রারম্ভিক বেতনের ৫০% প্রদানের ব্যবস্থা করেন। সেদিনের তার সেই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে আমাদের শিক্ষার উন্নয়নে নবদিগন্তের সূচনা করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী ২০০৬ সালের ১লা জুলাই থেকে প্রারম্ভিক বেতনের শতভাগ পাচ্ছেন সরকারি কোষাগার থেকে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনে ২৫ সদস্যের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়। ওই সময়ে আলোচনাকালে বাকশিস প্রতিনিধি দলের নেতা প্রফেসর এম. শরীফুল ইসলাম সরকারি শিক্ষকদের পেনশনের অনুরূপ বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা উত্থাপন করলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা প্রদান যুক্তিযুক্ত বলে উল্লেখ করেন এবং তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। সেদিনের শহীদ জিয়ার সেই প্রতিশ্রুতি তার সহধর্মিণী পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বাস্তবায়ন করে গেছেন। সে কারণেই আজ আর বেসরকারি কোনো শিক্ষক-কর্মচারীকে অবসর গ্রহণের পর খালি হাতে বিদায় নিতে হয় না। যুগান্তকারী এসব পদক্ষেপের জন্য এদেশের শিক্ষক সমাজ শহীদ জিয়াউর রহমানকে চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। শহীদ জিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে প্রয়াত শিক্ষক নেতা, শিক্ষক বন্ধু প্রফেসর এম. শরীফুল ইসলামের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তত্কালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে শহীদ জিয়ার জন্মদিবস ১৯ জানুয়ারিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস পালনের ঘোষণা দেন। তাই আজ ১৯ জানুয়ারি জাতীয় শিক্ষক দিবস। তবে দুঃখের বিষয়, জাতীয় শিক্ষক দিবস পালনে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই, কর্মসূচিও নেই।
ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতার জন্য সুদীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে। ’৭১-এর এই মহান মুক্তিযুদ্ধের ফলেই অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। এর জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, কোরবানি করতে হয়েছে অনেক জীবন। এই মুক্তিযুদ্ধে তত্কালীন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্য, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জিয়াউর রহমান। সেনানায়ক শহীদ জিয়া রণাঙ্গনে অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত বলিষ্ঠ নাম, চিরস্মরণীয় এক নাম।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আলোকে একটি শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচারের দ্বারা জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। ’৭১-এর রক্তঝরা দিনগুলোতে দেশের মানুষ যখন নেতৃত্বের সঙ্কটে দিশেহারা ও বিভ্রান্ত, ঠিক তখনই শহীদ জিয়ার কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই দিকনির্দেশনা ও স্বাধীনতার ডাক।
শহীদ জিয়ার ঘোষণায় ও স্বাধীনতার ডাকে মানুষ পায় প্রেরণা, হয় নতুন প্রাণের সঞ্চার। এরপর চলে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল সঠিক ও সময় উপযোগী। তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সাহসী ঘোষণা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
শহীদ জিয়াউর রহমান জাতির প্রতিটি সঙ্কটকালে ত্রাণকর্তা রূপে কাজ করেছেন। স্বাধীনতা অর্জনে তার অবদান যেমন ছিল অসাধারণ, তেমনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ছিল অতুলনীয়। দেশ যখন বাকশালের মোড়কে একদলীয় শাসনের কবলে নিমজ্জিত, তখনই তিনি আবার সঠিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করার যে চক্রান্ত চলছিল, ১৯৭৫ সালে শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে এদেশের বীর সিপাহী ও জনতা তা নসাত্ করে দিয়ে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একদিকে যেমন অনিশ্চিত শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংযুক্ত হয় আত্মপ্রত্যয়ের এক নতুন সুর, আত্মনির্ভরশীলতার এক নতুন ব্যঞ্জনা আর জাতীয়তাবাদের স্বকীয়তা, তেমনই আবার সিপাহী-জনতার মিলিত ঐক্যের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংহত হয়ে এক নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সূচিত হয় সংকীর্ণ অক্ষশক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে উন্মুক্ত বিশ্বের প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ার যাত্রা। শহীদ জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করায় বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তরাত্মা জাগরিত হয় নতুন প্রাণশক্তিতে। সংবাদপত্রের কণ্ঠে আবারও ফুটে ওঠে ধ্বনি, বিচার বিভাগ পায় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণের শক্তি। ব্যক্তি প্রাধান্যের কবল থেকে মুক্ত হয়ে রাজনীতির কলিগুলো বিকশিত হয়। আবার মৌলিক মানবাধিকার ফিরে পায় প্রাণের স্পন্দন। শহীদ জিয়ার সঠিক নির্দেশনার ফলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পরিলক্ষিত হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আর সারা দুনিয়ার মানুষ অবাক হয়ে দেখেছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সম্মানের জন্য বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ কিভাবে একতাবদ্ধ হয়ে অশুভচক্রের সব অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করে।
শহীদ জিয়াউর রহমান দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যে গতিসঞ্চার করেছিলেন নিঃসন্দেহে তা ছিল বৈপ্লবিক। তার একান্ত উদ্যোগের ফলেই কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং খাল খনন, রাস্তা ও পুল নির্মাণ হয়। প্রতিটি পল্লীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি ছুটে চলতেন বিদ্যুত্গতিতে।
শিশুকল্যাণের জন্য শিশু একাডেমি, যুব উন্নয়নের জন্য যুব মন্ত্রণালয় এবং মহিলা সমাজের কল্যাণের জন্য মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেন তিনি। তিনি ক্রীড়াবিদদের মান উন্নয়নে ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক সংস্কার করেন। যার ফলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা লাভের জন্য বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেন এবং তার দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের ফলেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমপ্রীতি ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারই প্রস্তাবনা ও উদ্যোগে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভারত, পাকিস্তান ও ভুটান এই ৭টি দেশের সমন্বয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগী সংস্থা (সার্ক) গঠন করা হয়, যা এ অঞ্চলে শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে চলেছে। ২০০৫ সালের ১২ই নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৩তম সার্ক সম্মেলনে সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা শহীদ জিয়াকে স্বর্ণপদক প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। সত্যিকার অর্থে বলা যায়, তিনিই ছিলেন উন্নয়নমুখী বাংলাদেশের স্থপতি ও সফল রাষ্ট্রনায়ক।
একথা খুবই স্পষ্ট যে, বর্তমানে দেশ এক সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। দেশের এই সঙ্কটকালে তার মতো বিচক্ষণ নেতার প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। এই মহান নেতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এবং তার নির্দেশিত পথে যেন চলতে পারি সেই প্রত্যাশাই করি।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ

No comments

Powered by Blogger.