শেকড়ের ডাক-রাজনীতি চাই, কুরাজনীতি নয় by ফরহাদ মাহমুদ

জাতীয় সংসদের সদ্যসমাপ্ত অধিবেশনে দীর্ঘদিন পর বিএনপির সংসদ সদস্যরা যোগ দিয়েছিলেন। আর তখনই জাতি সংসদের একটি ভিন্ন রূপ দেখতে পেল। শীতকালের নিস্তরঙ্গ নদীর মতো ঝিমিয়ে আসা সংসদ যেন হঠাৎ করেই ভরা বর্ষার প্রমত্তা নদীতে পরিণত হয়েছিল।

শৈত্যপ্রবাহে আক্রান্ত সংসদ হঠাৎ করেই চৈত্রের দাবদাহের মতো উত্তাপ ছড়াতে থাকল। আমরা তো এমনটাই চাই। এমন প্রাণবন্ত সংসদই মানুষ আশা করে। কিন্তু সেটি কি এমন করে? সভ্যতার সীমা পেরিয়ে এমন কদর্য ও কুৎসিতভাবে? সব কিছুতেই একটি সীমা বা পরিমিতিবোধ থাকা উচিত। আর তা না থাকলে কিন্তু নিজের অনলে নিজেকেই পুড়ে মরতে হয়।
বিগত সংসদ অধিবেশনে বিএনপির একজন নারী সংসদ সদস্য যে বক্তব্য রেখেছেন তা সভ্য সমাজের অনেককেই আহত করেছে। সংসদ অধিবেশনে এ ধরনের বক্তব্য প্রদানের নিন্দা জানিয়ে গত কয়েক দিনে পত্রপত্রিকায় বহু নিবন্ধ, মতামত ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই অবাক হয়েছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, একজন নারীর মুখ দিয়ে এ ধরনের শব্দ বা বাক্য আসে কী করে! সামাজিক আলাপ-আলোচনায়ও বিষয়টি তুঙ্গে আছে। আর আমার মতো কিছু মানুষ যতটা না আহত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে। কারণ, 'কথায় কথা বাড়ে, মথনে বাড়ে ঘি' প্রচলিত এই শ্লোকটির মতো করে সেই কথার সূত্র ধরে যদি কথা বাড়তেই থাকে, তাহলে পরিণতিটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা ভাবা যায় না। সে কারণেই ভয়। আরো ভয় হচ্ছে এই কারণে যে আমাদের বর্তমান সমাজে মাত্রাজ্ঞানহীন লোকজনের তো কোনো অভাব নেই। নিশ্চয়ই বর্তমান সংসদেও এর অভাব হবে না। আর প্রযুক্তির কল্যাণে তাঁদের এসব 'মূল্যবান' কথা আমরা যাতে না চাইলেও অতি সহজে শুনতে পারি তার সব ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। এমনিতেই কাটছাঁটে অনভ্যস্ত অনেক টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। তার ওপর আবার সংসদের জন্য আলাদা টেলিভিশন চ্যানেল খোলা হয়েছে। আর তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় জানা নেই বলেই বেশি ভীত হচ্ছি। বুড়ো বয়সে এসব বেফাঁস কথায় সন্তান-সন্ততি বা নাতি-পুতির সামনে বেইজ্জত হওয়ার কোনো মানে হয় না।
কাণ্ডজ্ঞান, বিচারবুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনাবোধ, মাত্রাজ্ঞান, পরিমিতিবোধ কিংবা এ ধরনের অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় আছে। কিন্তু হাল আমলে আমাদের রাজনীতিবিদদের আচার-আচরণ বা কথাবার্তায় এ ধরনের শব্দের অস্তিত্ব খুঁজে হতাশ হতে হয়। স্থান-কাল-পাত্রের যে পার্থক্যবোধ তাও ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কোথায় কী বলা যায়, কোথায় কী করা যায়_সেই জ্ঞানও লোপ পাচ্ছে। শালীন ও অশালীন, রুচি ও অরুচি, আচার ও অনাচার, সভ্যতা ও অসভ্যতা_বিপরীতার্থক এই শব্দগুলো কেমন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? সংসদ হচ্ছে একটি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। একটি দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে সেই সম্পর্কিত নীতি নির্ধারিত হবে এখানে। আইন প্রণয়ন করা হবে। সেই সংসদে যদি খিস্তিখেউড় চলে, তাহলে হাট-বাজারে কী হবে?
পৃথিবীর সব সমাজেই সব ধরনের লোক থাকে। কিন্তু খারাপ-ভালোর একটি ভারসাম্যের ওপরই নির্ভর করে সেই সমাজের পরিচিতি, উন্নতি, অবনতি ও অস্তিত্ব। সেই অর্থে আমাদের সমাজেও সব ধরনের লোক আছে এবং অতীতেও ছিল। আর ছিল বলেই বাংলা ভাষায় তাদের বিশেষণ বা পরিচিতির জন্য নানা ধরনের শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। খারাপ লোকজনকে মোটা দাগে বলা হতো নীচ, হীন বা নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোক। কখনো বা তাদের মানুষ হিসেবেই স্বীকার করা হতো না, সম্বোধন হতো অমানুষ। সমাজে চলার জন্য নির্দিষ্ট কিছু গুণাবলির প্রয়োজন হয়, সেগুলো না থাকলে কোনো মানুষকে বলা হয় অসামাজিক। এমনি প্রকারভেদে আছে অমার্জিত, অশিষ্ট, অসভ্য, অভব্য, অভদ্র, অশালীন, অরুচিকর ইত্যাদি শব্দমালা। আবার কিছু মানুষের আচার-আচরণ যদি আরো নিম্নগামী হয় তখন তাদের বোঝাতে বলা হয় ইতর, বদমাস, ঘৃণিত, বর্বর, ছোটলোক এবং এ জাতীয় কিছু শব্দ। তাতেও যখন তাদের বর্ণনা যুৎসই হয় না, তখন কিছু বিদেশি শব্দ বা উপসর্গের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে কমিনে, কমজাত, কমবখত, বেশরম, বেলাজ, বেহায়া ইত্যাদি। হয় তো তাতেও তাদের প্রকাশ সম্পূর্ণ হয় না। তাই মানুষ তাদের তুলনা করা হয়েছে বিশেষ কিছু বন্য প্রাণীর সঙ্গে। যেমন, খাটাশ, খচ্চর, নর্দমার কীট ইত্যাদি। তাতেও ক্ষোভ না মিটলে বিশেষ বিশেষ প্রাণীর বাচ্চা বলে গালিও দেওয়া হয়। আঞ্চলিকভাবেও বাংলা ভাষার ভাণ্ডারে এ রকম বহু শব্দ জন্ম নিয়েছে। যেমন, অজাত, কুজাত, বেজন্মা ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের মহান জাতীয় সংসদে যে ভাষায় কথা হয়েছে, যিনি বা যাঁরা বলেছেন, তাঁদের কোন কোন শব্দ দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করা যাবে, তা বোধগম্য নয়।
অতীতে আমাদের বা কোনো দেশের সংসদে এ ধরনের কুৎসিত বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। কাজেই জাতীয় সংসদে এ ধরনের বক্তব্য প্রদানের কারণ কী_সবার আগে তা আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। কারণ নানা রকমের হতে পারে। এরা হয়তো জানে না, স্বামী-স্ত্রী একান্তে বস্ত্রের যে ধরনের ব্যবহার করে সন্তান-সন্তুতির সামনে সেই একই ব্যবহার কাম্য নয়। সভ্যতা-ভব্যতার জন্য যে ধরনের পারিবারিক শিক্ষা থাকা প্রয়োজন, তা হয়তো এদের নেই। সবচেয়ে বড় কারণ যেটি হতে পারে, সেটি হলো এরা যেখানে আসার যোগ্য নয়, সেখানেই নিয়ে আসা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলাটা সম্ভবত অনুচিত হবে।
কিন্তু এরা সংসদে আসে কিভাবে? এ জন্য আমাদের বর্তমান রাজনীতি ও এর কুশীলবরাই কী দায়ী নন। রাজনীতি হয়ে গেছে লাভজনক ব্যবসা। এখানে বিনিয়োগ করলে বহুগুণে তা তুলে নেওয়া যায়। ফলে রাজনীতি হয়ে পড়েছে সভ্যতার বিপরীত মেরুতে থাকা তস্কর, লুটেরা, দখলবাজ, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র। প্রকৃত সমাজকর্মী, সমাজহিতৈষী, সজ্জন, সভ্য এবং মান-মর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা আজকাল কলুষিত রাজনীতি থেকে দূরত্ব রক্ষা করে চলেন। এরই তো প্রমাণ পাওয়া গেল বিগত দিনের সংসদ অধিবেশনে। আজ ওই নারী সদস্যের কথা শুনে কেউ কেউ পুলকিত হয়েছেন, কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু অতীতে যখন অশ্লীল ইঙ্গিত দিয়ে বক্তৃতা করা হয়েছে, তখন কি ভাবা উচিত ছিল না যে অশ্লীল কথাবার্তা আরো অশ্লীলতাকেই টেনে আনবে। আর আজ যারা পুলকিত হচ্ছেন তাঁদেরও ভাবা উচিত তাঁদের নেতানেত্রীদের নিয়েও বাজারে অনেক মুখরোচক গল্প চালু আছে। এই ধারা চলতে থাকলে সেসব মুখরোচক গল্পও একদিন এই সংসদ অধিবেশনে চলে আসবে। তখন কি আপনাদের পুলক থাকবে? আপনাদের পুলক থাকলেও সমাজের বহু মানুষেরই মুখ সেদিন লজ্জায়, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে যাবে।
আমাদের রাজনীতি যে কতটা অধঃপতনে গেছে, তা তো আমরা বছরের পর বছর দেখে আসছি। শুধু কলুষিত কথাবার্তা নয়, কলুষিত কাজকর্মও তো আমরা কম দেখিনি। জনসভায় বোমা হামলা, নির্বাচনের পর বিরোধী দলকে শারীরিকভাবে শেষ করে দেওয়া, গণতন্ত্রের নামে জমিদারি প্রথা চালু করা, দেশের সর্বনাশ করে নিজের আখের গোছানো_এসবই তো হয়ে উঠেছে এখন এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আর সেই সঙ্গে রাজনীতির ভাষা হয়ে পড়ছে ক্রমেই লাগামহীন। তাই দোহাই রাজনীতিবিদদের, হয় আমাদের রাজনীতি উপহার দিন, আর না হয় রাজনীতিকে নিষ্কৃতি দিন। ভালো রাজনীতি উপহার দিতে অক্ষম হলে আপনারা সরে যান। কিন্তু কুরাজনীতি করে সভ্যতাকে পেছনমুখী করার চেষ্টা করবেন না। এর পরিণতি না আপনার জন্য, না আমার জন্য, না দেশের জন্য_কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.