প্রকৃতির পাঁজর খুবলে নিচ্ছে দস্যুরাঃ পাহাড় কাটা বন্ধ করুন এখনই


ভূমিদস্যু, নগর সামন্ত এবং প্রশাসনের ছত্রছায়ায় লালিত দুষ্কৃতকারীদের কবলে পড়ে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিবেশ-পরিবেশ। বন উজাড় করে খাস বনাঞ্চল ও নদী দখলের পাশাপাশি চলছে পাহাড় দখল তথা পাহাড় কাটার তাণ্ডব।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পাহাড়কে পরিণত করা হচ্ছে সমতল ভূমিতে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই নৃশংস অভিযানে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে মদত দিচ্ছে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। কোথাও প্রকল্পের নামে, কোথাও সমিতির নামে পাহাড়ের মাটি কেটে ভরাট করা হচ্ছে নিচু জমি। আবার পাহাড়ের মাথা মুড়িয়ে সেখানে প্লটবাণিজ্য শুরু করেছে ভূমি সিন্ডিকেট। ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে প্লট বিক্রি করে এরা হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি এভাবেই প্রকাশ্যে চলছে পরিবেশ ধ্বংসের আয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।

পাহাড় কেটে ভূমি দখল, মাটি ভরাট ও বিক্রিবাণিজ্য নতুন কিছু নয়। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক পাহাড় ও টিলা সম্পূর্ণ এবং আংশিক সাবাড় হয়ে গেছে। কিছুদিন ধরে তা প্রায় হিড়িকে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে ৫০ একর জমি দখল করে নিয়েছে চট্টগ্রাম বাস্তুহারা লীগ ও ভূমিহীন সমিতির নাম করে সাত সদস্যের ভূমি সিন্ডিকেট। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম শহরের অদূরে দখল করা পাহাড়ের জমিতে তৈরি প্লট বিক্রি করে তারা হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। জানা গেছে, সাবেক জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামের পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ছিন্নমূল মানুষকে বসবাস করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে সেখানে বাস্তুহারা লীগ সমন্বয় পরিষদ, জেলা ও মহানগর শাখার ব্যানারে অফিস ঘর তোলা হয়েছে। টাঙানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান প্রধামন্ত্রীর ছবি সংবলিত সাইনবোর্ড। এখান থেকেই সিন্ডিকেট সদস্যরা ৫০ একর জমিতে দুই হাজার প্লট বানিয়ে আট হাজার টাকা করে বিক্রি করছে। এ ব্যাপারে সীতাকুণ্ড থানার ডিউটি অফিসার জানিয়েছেন, প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী প্রকল্পের মাটি ভরাটের জন্য কেটে ফেলা হচ্ছে আস্ত পাহাড়। পাহাড়ের মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে পানি শোধনাগার প্রকল্পের নিচু জমি। রাঙ্গুনিয়া প্রকল্প এলাকার এই পাহাড় ধ্বংসের প্রশাসনিক দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। জানা গেছে, অসাধু প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা মিলে বালু দিয়ে ভরাটের কথা থাকলেও নির্ধারিত স্থানে ফেলছে পাহাড়কাটা মাটি। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ অজুহাত দাঁড় করিয়ে বলছে, যেখানে মাটি ভর্তি করার চুক্তি আছে, কেবল সেখানেই মাটি দেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, এই একই খাতে কাটা হচ্ছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার পাহাড়। বায়েজিদ থানার চন্দননগর এলাকার একটি পাহাড় কেটে নিয়ে যাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। এমনকি বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীর নিজ এলাকার কাছে বিশাল পাহাড় এখন প্রায় নিঃশেষ হওয়ার পথে। বালুর বদলে পাহাড় বিরান করার ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। তিনি বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের এখতিয়ারে বলে দায় সেরেছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে বেচা কিংবা উন্নয়নের নামে বালুর বদলে পাহাড়ের মাটির ব্যবহার গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার শামিল। নদীর তলদেশ দখল যেমন পরিবেশের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত, তেমন পাহাড়ের শরীর কাটা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের পাঁজর উপড়ে নেয়ার মতোই সজ্ঞান নৃশংসতা। সরকারি দলের নামে দুর্নীতিবাজ প্রশাসন যদি এভাবে নদী, বন, পাহাড় ধ্বংসের কাজে লিপ্ত থাকে, তাহলে ‘পরিবেশ গেল’ বলে চিত্কার করা একধরনের নৈরাজ্যকেই মনে করিয়ে দেয়। পাহাড় কাটার ফলে শুধু পরিবেশেরই অপূরণীয় ক্ষতি হয় না, একইসঙ্গে বিনাশ হয় প্রাণিবৈচিত্র্য; শুরু হয় চারপাশের বন উজাড়ের প্রক্রিয়া। বনাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের জীবনযাপনের ওপরও তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। উজাড় করা বনভূমিতে নতুন বনায়নের অবকাশ থাকে, নদী সংস্কার করে তাকে হয়তো ফিরিয়ে দেয়া যেতে পারে বহমানতা; কিন্তু কাটা পাহাড়ের আর মাটি জুড়ে দেয়া যায় না। পাহাড় কাটলে ভূমি সৌষ্ঠব হারায়, নিসর্গ বদলে যায়; বিজ্ঞানীরা বলেন বেড়ে যায় ভূমিকম্পের আশঙ্কা। এসব যদি চলে সরকার তথা প্রশাসনের চোখের সামনে, তাহলে কোপেনহেগেন সম্মেলনে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চেঁচিয়ে কী লাভ! আমাদের দাবি, যারা পাহাড় কেটেছে, তাদের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক এবং কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হোক যাতে কেউ পাহাড়ের গা থেকে কেটে নিতে না পারে এক কোদাল মাটিও।

No comments

Powered by Blogger.