দ্রব্যমূল্য বাড়ছেইঃ সরকারের কি কিছুই করার নেই?


আশ্বাসবাণী শুনিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ভারতীয় কৌশল এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীরাও বেশ ভালোমত রপ্ত করে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যের কারণে দিশেহারা ভোক্তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বলেছেন, আগামী জুনের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি পুরোপুরি কার্যকর হবে।
এরপরই বাজার নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রীর আগাম ঘোষণা গত এক বছরে একটিবারের জন্য কার্যকর হয়েছে, তেমন কোনো নজির নেই। তা সত্ত্বেও এবার তার কথা ফলে যাবে বলে যদি আমরা ধরে নিই তবে আমাদের স্বীকার করতে হবে, জুনের আগে জিনিসপত্রের দাম কমছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন পণ্যমূল্য এখন স্থিতিশীল আছে। স্থিতিশীল থাকার অর্থ হচ্ছে মোটামুটি স্বাভাবিক থাকা। পণ্যমূল্য যদি স্বাভাবিকই থাকবে তবে তিনি জুন নাগাদ বাজার তথা পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসার কথা বলছেন কেন? এর একমাত্র অর্থ হচ্ছে বাজার এখন নিয়ন্ত্রণে নেই। আসলেই যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ক্রমেই বেড়ে চলেছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। বাজারে এখন এক কেজি রসুনের দাম ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। বছরখানেক আগেও এই রসুন বিক্রি হয়েছে ২৪-২৫ টাকা কেজি দরে। অর্থাত্ বর্তমান সরকারের এক বছরে রসুনের দাম বেড়েছে ৩৩৫ শতাংশ। আদার দাম একই সময়ে ৬১ শতাংশ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ মসুর ডাল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন চড়া মূল্যের কারণে। চাল, চিনি, আটার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। টিসিবির দেয়া তথ্য মোতাবেক, মাত্র গত এক মাসে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ, পাইজম ও লতাশাইল চালের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং নাজিরশাইল ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। কোথাও এখন ২৮ টাকা কেজির কমে সবচেয়ে নিম্নমানের মোটা চালও পাওয়া যাচ্ছে না। গত এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ৭২ শতাংশ। এ দাম আরও বাড়ার আভাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বাজারে এখন প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা দামে। খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ২৪ টাকা দরে। এক মাসে আটার দাম বেড়েছে ৯ শতাংশ। মাছ-মাংসের দিকে হাত বাড়ানো যায় না। বাণিজ্যমন্ত্রী যদি এ অবস্থাকে স্থিতিশীল বলেন তবে অস্থিরতার সংজ্ঞা কী সেটা আমাদের বুঝিয়ে বলা হোক।

তিনি অবশ্য বর্তমান বাজার দরের পক্ষে সাফাই গাইতে ভারতের উদাহরণ টেনেছেন। তার মতে, আমাদের খাদ্যপণ্যের বাজারদর ভারতের তুলনায় সহনীয়। তিনি অবশ্য তার এই বক্তব্যের পক্ষে কোনো দৃষ্টান্ত তুলে ধরেননি। বরং যে কথা তিনি বলেননি সেটা হচ্ছে, ভারতে নিম্নতম মজুরিসহ বিভিন্ন স্তরের বেতন আমাদের চেয়ে বেশি। ফলে ভারতীয় ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতাও আমাদের চেয়ে বেশি। তিনি একথাও বলেননি যে, ভারত সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক অতি ধীরগতিতে হলেও নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে জনগণকে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। তারপরও ভারতীয় মিডিয়ায় খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের জন্য প্রায় প্রতিদিন তুলোধুনা করা হচ্ছে সরকারকে। ভারতের কৃষিমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ে কৈফিয়ত দিতে দিতে কূল পাচ্ছেন না। একবারও তারা বলছেন না সবকিছু ঠিক আছে। বরং তাদের বক্তব্য হলো, দ্রব্যমূল্য হ্রাসের চেষ্টা চলছে। অথচ আমাদের মন্ত্রী মহোদয় ক্রেতাদের জুন পর্যন্ত অপেক্ষার পরামর্শ দিয়েই খালাস।
বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান স্বীকার করেছেন, ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের সুযোগ দিয়েও কোনো ফায়দা হয়নি। তাদের লোভ অতি মুনাফার প্রতি। কিন্তু কথা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভে বাজারে যেন অস্থিরতা সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করার কোনো মেকানিজম কি আমাদের দেশে নেই? সেগুলো কাজে লাগানো হচ্ছে না কেন? তবে কি আমরা ধরে নেব, বাজারকে এলোমেলো করে দিয়ে যারা মুনাফার পাহাড় গড়ছেন তাদের মধ্যে বেনিফিশিয়ারি হিসেবে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি’র লোকজনও আছেন? যে যেখানেই থাকুন, আমাদের কথা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দায় সরকার এড়াতে পারে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির গল্প শোনানো হচ্ছে। কিন্তু গত এক বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রেসরিলিজ দেয়া ছাড়া টিসিবি আর কিছুই করেনি। তাই ক্রেতারা এখন কথা নয়, কাজ চায়।

No comments

Powered by Blogger.