নোনা পানির গ্রাস-পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে

রক্তে উদয়, পানিতে মৃত্যু- বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণীটি আছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে তা সত্যে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। উপকূলের ১৯টি জেলায় নোনা পানির অনুপ্রবেশ এতটাই বেড়ে গেছে যে সেসব ভূখণ্ড প্রচলিত কৃষিকাজের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে।

ভূগর্ভস্থ স্তর দিয়ে এ পানি বৃহত্তর ফরিদপুরের পুরোটাতে ও বৃহত্তর ঢাকারও কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সদ্যসমাপ্ত গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো না গেলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ভূগর্ভস্থ স্তর দিয়ে নোনা পানির অনুপ্রবেশ ঢাকা মহানগরীতেও এসে যাবে। অন্যদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়াও সমানতালে এগিয়ে চলেছে। ফলে দেশ ক্রমেই এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে।
নোনা পানির অনুপ্রবেশের ফলে শুধু যে কৃষিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা-ই নয়, মিঠাপানিনির্ভর উদ্ভিদ বা গাছপালা মরে যাবে, মিঠাপানির মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনকি নোনা পানির কারণে বিভিন্ন স্থাপনাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতি কেন হচ্ছে? এর বহু রকম কারণের মধ্যে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অভিন্ন নদীগুলো থেকে ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার, নদী-নালা-খাল-বিল-জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, ভূগর্ভে পানির অনুপ্রবেশ ঠিকমতো না হওয়া ইত্যাদি। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রতিবছরই আমরা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচের মাধ্যমে কৃষিজমির পরিমাণ বাড়িয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টিপাতের চার মাস ছাড়া এগুলো শুকনো থাকে। এগুলোতে যদি সারা বছর পানি থাকত, তাহলে সারা বছরই পানি চুইয়ে ভূগর্ভে যেতে পারত। কিন্তু বর্তমানে আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ পানি ভূগর্ভে যেতে পারে না। অথচ আমরা ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করছি কয়েক গুণ বেশি। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছরই নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভের সেই খালি হওয়া পানির স্তর ক্রমে সাগরের পানি এসে ভরাট করছে। ঢাকা শহরে পানি উত্তোলন ও পানি অনুপ্রবেশের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি। ওপরের স্তর প্রায় সবটাই কংক্রিট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। চারপাশের নদীগুলোও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জলাশয় প্রায় নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় ঢাকার যে পরিণতি ধেয়ে আসছে, তাকে রোধ করা খুবই কঠিন হবে। সেই সঙ্গে আছে নদীদূষণ। ভূগর্ভস্থ পানির বদলে নদীর পানি ব্যবহারেরও সুযোগ কমে যাচ্ছে। চাঁদনীঘাট শোধনাগারে বুড়িগঙ্গার পানি শোধনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সায়েদাবাদ শোধনাগারে শীতলক্ষ্যার পানি কোনো রকমে শোধন করা হলেও তা ক্রমেই পানের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। নদী রক্ষায় হাইকোর্টের রায়ও উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। হাজারীবাগের ১৫৫টি ট্যানারি শিল্প ইউনিটকে এখনো সরানো যায়নি।
অভিন্ন নদীগুলোতে ভারতের একতরফা বাঁধ তৈরি বা গতিপথ পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী শীতকালে প্রায় সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যায়। এককালের প্রমত্তা পদ্মা তখন হেঁটে পার হওয়া যায়। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীরও একই অবস্থা। অন্যদিকে ব্রিটিশ আমলের পর থেকে নদীগুলোতে কোনো খননকাজ না হওয়ায় সেগুলোর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচানো আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে অতিদ্রুত আমাদের নদী খনন শুরু করতে হবে। অভিন্ন নদীগুলোর পানিপ্রবাহের ন্যায্য হিস্যা পেতে উজানের দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি আমরা আন্তর্জাতিক আদালতের সহায়তা নিতে পারি। প্রতিবেশী বাঁচল কি মরল তা আমার দেখার বিষয় নয়- ভারতের এই মনোভাব থেকে আমাদের রক্ষা পেতেই হবে।
সোজা কথা, আমাদের আজ অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে। বিষয়টিকে সেভাবেই গুরুত্ব দিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালাতে হবে। সরকার পানি আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছে। সেটিকে আরো বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অবিলম্বে আইনে পরিণত করতে হবে এবং কঠোরভাবে সেই আইনসহ সংশ্লিষ্ট আইনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নদীগুলোকে বাঁচানোর জন্য সব রকম প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.