দুর্ঘটনা-তারেক মাসুদের অসমাপ্ত জীবন, অপূর্ণ স্বপ্ন এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল by আবু সাঈদ খান

জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি মৃত্যু। প্রাকৃতিক এই অনিবার্যতার কোনো ব্যত্যয় নেই। তবু পরিণত বয়সের স্বাভাবিক মৃত্যুও স্বজনদের বেদনাহত করে। আর মৃত্যু যদি হয় অপরিণত বয়সে, দুর্ঘটনাজনিত তবে তা স্বজনের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন!
সংবাদপত্রে কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে যখন কোনো সড়ক দুর্ঘটনার খবর দেখি; তখন কয়েকটি দৃশ্য, কয়েকটি মৃত্যু

আমাকে আলোড়িত করে। ১৯৮৫ সালের ২২ আগস্ট ফরিদপুর-বরিশাল সড়কের দিগনগরে একটি বাস ব্রিজের রেলিং ভেঙে নদীতে পড়ে গেলে প্রায় ত্রিশজন মানুষের মৃত্যু ঘটে। আমি তখন ফরিদপুরে। রাতের ঘটনাটি যখন সকালে খবর হিসেবে শুনি, তখন অজানা-অচেনা মৃত ব্যক্তিদের কথা ভেবে ব্যথিত হই। পরদিন দুপুরে কি সন্ধ্যায় খবর এলো, আমার ছোট বোন রানীর স্বামী শহীদুল আলম সেই মৃত যাত্রীদের একজন। তারপর রানী বৈধব্যের কষ্ট বুকে চেপে তিন বছরের ছেলে সুমন ও এক বছরের মেয়ে রিমিকে নিয়ে নতুন এক জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। জীবন থেমে নেই। তবে এর বেদনাদায়ক প্রকাশ ঘটে ঈদের দিনে, পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
বিয়ের পূর্বেই জেনেছিলাম, আমার শ্বশুর মোহাম্মদ আলী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু সে বেদনা পরিবারটিকে কীভাবে তাড়িত করছে তা তখন বুঝিনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের পরিবারের মতো এখানেও শোকের প্রকাশ দেখি। আমার শ্বশুরের মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮১ সালের ১৪ এপ্রিল, ১ বৈশাখ। সারাদেশে পহেলা বৈশাখ নববর্ষের আনন্দে মেতে ওঠে, আর এই পরিবারে নামে শোকের ছায়া। পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সঙ্গত কারণেই বিয়ের পর আমি রমনা বটমূলে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত হই। আমাদের সন্তান অনিক যখন কিছুটা বড় হলো, তখন আমার স্ত্রী শামীমা বলল, ছেলেটাকে নববর্ষের আনন্দ থেকে দূরে রাখা ঠিক হবে না। তারপর থেকে আমি অনিককে নিয়ে নববর্ষের অনুষ্ঠানে যাওয়া শুরু করি।
বল্পুব্দ প্রকৌশলী মানিকগঞ্জের আনিসুর রহমান খানের সঙ্গে রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের বহু চরাই-উতরাই পেরিয়েছি। '৯২ সালের ঘটনা। সহসা একদিন খবর এলো, সেই প্রিয় মানুষটি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এভাবে অকালে নিভে গেল একজন রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধার জীবন।
এ প্রসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও তিনটি মৃত্যুর উল্লেখ করতে চাই। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ঢেউ সারাদেশেই আলোড়ন তুলেছিল, তখন ফরিদপুরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিন তরুণ_ মনোয়ার হোসেন, লিয়াকত হোসেন ও ইমাম উদ্দিন আহমেদ। এই তিনজনকে বলা হতো ট্রায়ো। ষাটের দশকেই আমি এই তিনজনের সানি্নধ্যে এসেছিলাম।
ইমাম উদ্দিন আহমেদ আমৃত্যু সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন, ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে এবং '৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। মনোয়ার হোসেন ন্যাপ করতেন। পরে যুক্তরাজ্যে নিবাস গড়েছিলেন। লিয়াকত হোসেন রাজনীতি ছেড়ে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেছিলেন। তিনজনের জীবন তিন ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল, কিন্তু মৃত্যু ছিল একই নিয়মে বাধা। ১৯৯৩ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় লিয়াকত হোসেন প্রাণ হারান। ২০০৪ সালের ৯ জানুয়ারি লন্ডনে সড়ক দুর্ঘটনায় বিদায় নেন মনোয়ার হোসেন। ২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের কমলাপুরে বাড়ির কাছেই নিভে যায় ইমাম উদ্দিন আহমেদের জীবনপ্রদীপ।
সড়ক দুর্ঘটনার খবর শুনলে মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল থেকে এসব স্বজনের মুখ ভেসে আসে। আজ আরেক স্বজন হারানোর বেদনায় সমগ্র জাতিই শোকাহত, স্তম্ভিত। তিনি প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। এক সপ্তাহ আগে ১৩ আগস্ট তার সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন মেধাবী সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ আরও তিনজন।
তারেক মাসুদ ও আমার জন্মস্থান একই জেলায় হলেও পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। দু'জনের কর্মক্ষেত্র আলাদা। আমি যখন সক্রিয় রাজনীতিতে, গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় আত্মগোপনে কিংবা কারাগারে, তখন আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র নির্মাণ ও আন্দোলনে নিবেদিত।
তারেকের চলচ্চিত্র নির্মাণে আসা বিস্ময়কর। যার শৈশব-কৈশোর কেটেছে মাদ্রাসায়। স্বাধীনতার পূর্বে আমার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বাহিরদীয়া মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন তারেক। মনে পড়ে, '৭০-এর নির্বাচনে বাহিরদীয়া গ্রামে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে গিয়েছিলাম। তখন ওই মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা আশরাফ আলী প্রাদেশিক পরিষদে নেজামে ইসলামীর টিকিটে প্রার্থী হয়েছিলেন। তার সমর্থক মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ সাওয়াল-জওয়াব করেছিলাম। এখন জানতে ইচ্ছা হচ্ছে_ তখন কি তারেকও তাদের মধ্যে ছিলেন!
মুক্তিযুদ্ধ তারেককে বদলে দিয়েছিল। তিনি শিকড়ের সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছিলেন। তার প্রথম সৃষ্টি শিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে আদম সুরত। পত্রিকায় আলোচনা দেখে ছবিটি দেখার জন্য আগ্রহী হয়েছিলাম। একদিন আহমদ ছফা ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন; কিন্তু আজও দেখা হয়নি।
১৯৯৫ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ প্রবাসজীবন চুকিয়ে দেশে এলেন 'মুক্তির গান' নিয়ে। আমি টিকিট কেটে জাদুঘর মিলনায়তনে ছবিটি দেখে মুগ্ধ হলাম। তারপর তিনি যখন 'মুক্তির কথা' নির্মাণ করলেন, তখন আচমকা তারেক মাসুদের ফোন। অতি পরিচিতজনের মতো বললেন, তারেক মাসুদ বলছি। আপনি আমাকে চেনেন না, আমি আপনাকে বহুদিন ধরে চিনি। আপনার থানার বীর নারীদের নিয়ে সিনেমা তৈরি করেছি। আপনি দেখতে আসবেন। গিয়েছিলাম সে প্রদর্শনীতে। সেদিনই প্রথম সামনাসামনি কুশল বিনিময়।
তারেকের ছোট ভাই সাঈদ মাসুদের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। ও ভাঙ্গা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) প্যানেলের সহ-সভাপতি প্রার্থী ছিল। তখন ওদের বাড়িতে গিয়েছি। তখন ওর কাছ থেকে তারেক মাসুদের কথা শুনেছিলাম কি-না মনে নেই। সাঈদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, তার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ল, যখন সে সমকালের পাঠক ফোরাম সুহৃদ সমাবেশের ভাঙ্গা শাখার সভাপতি হলো।
২০০৯ সালে ভাঙ্গা সুহৃদ সমাবেশের পক্ষ থেকে গৌতম স্মৃতি পদক প্রদান অনুষ্ঠান হলো। পদক দেওয়া হয়েছিল নজরুল সঙ্গীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিলকে। অনুষ্ঠানের বড় আকর্ষণ অনুষ্ঠান শেষে তারেক মাসুদের ছবি 'মুক্তির কথা' ও 'মুক্তির গান' দেখানো হয়েছিল। অনুষ্ঠানে তারেক ও ক্যাথরিন ছিলেন। সাঈদ আগেই বলেছিল, দুপুরে আমাদের বাড়িতে খাবেন। সেখানেই তারেক, ক্যাথরিন, শাকিল, মিজানুল ইসলাম মিজুসহ দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হলো। তারেক '৪৭ সালের পটভূমিতে একটি ছবি বানানোর কথা জানালেন। এ জন্য বেশ কিছু বই জোগাড় করেছেন। পড়াও শুরু করেছেন। জানালেন, এর মধ্যে আমার লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর' ও 'স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি'ও রয়েছে। আমিও দু'একটি বইয়ের কথা বলেছিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নোটবইতে তা টুকে নিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, খুব পরিকল্পিত মানুষ।
তারপর টেলিফোনে কখনও কখনও কথা হয়েছে। একবার 'মুক্তির কথা' চলচ্চিত্র দেখতে নগরকান্দা যাবেন। আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারিনি। যেতে পারিনি আরও দু'একটি আমন্ত্রণেও।
সর্বশেষ তারেকের সঙ্গে দেখা ফরিদপুরে। কবি জসীম উদ্দীন হলে তার 'রানওয়ে' সিনেমার প্রদর্শনীতে। তারেক ফোনে বললেন, ফরিদপুরে ছবি ফেরি করতে যাচ্ছি। আপনি ছাড়া ভাবতে পারছি না। এবার ব্যস্ততার মধ্যেও রাজি হলাম।
ছবি শুরুর আগে কিছু বলতে হবে। অতি সংক্ষেপে আমার দেখা মুক্তির গান, মুক্তির কথা, মাটির ময়না ও নরসুন্দর নিয়ে কথা বললাম। তারপর বিস্ময়-বিমুগ্ধচিত্তে রানওয়ে দেখলাম। আমি ছবির বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের যোগ্য ব্যক্তি নই। তবে ছবির মর্মবাণী আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করল। ধর্ম ও লোকায়ত সংস্কৃতি কী করে একাকার হয়ে গিয়েছে তার নিপুণ চিত্রায়ন দেখলাম। তার আড়ালে উঁকি দিল একজন শক্তিশালী নির্মাতা। যিনি আমাদের চলচ্চিত্রকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে যারা জীবনমুখী ছবি নির্মাণে ব্রতী, তিনি তাদের মধ্যে কেবল অগ্রগণ্যই নন, আমাদের ছবিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে গেছেন।
ছবি দেখে যখন গেটে এলাম, তখন তারেকের নির্দেশে ক্যামেরায় ফ্লাশ লাইট জ্বলে উঠল। তারেক বললেন, এবার রানওয়ে সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বলুন। তারেক বলেছিলেন, কাল থাকলে দিনে এক সঙ্গে আড্ডা দেব, জরুরি কাজে সকালেই ঢাকা চলে আসতে হয়েছিল। পরের সপ্তাহে তারেকের 'রানওয়ে' নিয়ে লিখলাম। সকাল ১১টার দিকে তারেকের ফোন, আমার হাতে এখন সমকাল, পদ্মার বুকে ফেরিতে বসে লেখাটি পড়লাম। 'রানওয়ে' নিয়ে কেউ এভাবে লেখেনি। আপনার এই সাপোর্ট আমাকে আরও উৎসাহিত করল। বললাম, ওটা আপনার প্রাপ্য।
তারেকের ছবিগুলো দেখে মনে হয়েছে বাণিজ্য নয়, সস্তা জনপ্রিয়তা নয়, সামাজিক অঙ্গীকার থেকে কাজ করেছেন। তবে কোনো ছকবন্দি থাকেননি। প্রতিটি ছবিতেই নতুন স্বাদ দিয়েছেন। ছবিতে মেসেজ আছে, তবে শৈল্পিক সৌন্দর্যকে ক্ষুণ্ন করে তা বাণীপ্রধান হয়ে ওঠেনি। শিল্প-সৌন্দর্যমণ্ডিত জীবনধারার ছবির তিনি অগ্রগণ্য পুরুষ। অনেক ক্ষেত্রেই মনে হবে তিনি নির্লিপ্ত, তবে সত্যানুসন্ধানী। তার একটি মন্তব্য তাকে বুঝতে সহায়ক হবে। তিনি ধর্ম সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন_ 'আমি ধর্মবিরোধী নই, ধর্মাসক্তও নই। কিন্তু আমি এক্সট্রিমলি ইন্টারেস্টেড ইন রিলিজিয়ন।'
এই শিল্পী দীর্ঘায়ু হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতেন, তা নিয়ে কোনো সংশয়ের সুযোগ নেই। তার অপরিণত ও অস্বাভাবিক মৃত্যু একজন মাকে সন্তানহারা, একজন নারীকে স্বামীহারা করল না, একটি শিশুকে পিতৃহারাই করল না; আমাদের চিন্তা ও চলচ্চিত্রে অপরিমেয় এক শূন্যতা সৃষ্টি করল।
একই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন মেধাবী সাংবাদিক মিশুক মুনীর। মিশুকের সঙ্গে কবে পরিচয় হয়েছিল, মনে পড়ছে না। তিনি এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী হয়ে দেশে ফেরার পর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে এটিএন নিউজকে গতিশীল করতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন, সে খবর জেনেছি। এটিএন নিউজে একটি প্রোগ্রামে গিয়ে মনে হলো মিশুক মুনীরের সঙ্গে দেখা করি। তিনি ছিলেন না। টেলিফোন নম্বর নিয়েছিলাম। কিন্তু ফোন আর করা হলো না।
কিছুদিন আগে তারেক ফোনে বলেছিলেন, কেবল অনুষ্ঠানেই দেখা হয়। একদিন কি আড্ডা দিতে পারি না। সেই আড্ডাও দেওয়া হলো না।
তারেকের অসমাপ্ত 'কাগজের ফুল' তার পত্নী ক্যাথরিন মাসুদ সম্পন্ন করবেন বলে জানিয়েছেন। কেবল তারেকের পত্নী হিসেবেই নয়, সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে তারেক মাসুদের সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা অনন্য। ক্যাথরিনের হাতে নির্মিত হয়ে 'কাগজের ফুল' আলোর মুখ দেখুক, সেই প্রত্যাশাই করব।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.