বঙ্গবন্ধু ও ওরিয়ানা ফালাচি by হাসান ফেরদৌস

ওরিয়ানা ফালাচি তাঁর ইন্টারভিউস উইথ হিস্টরি গ্রন্থে ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফি ভুট্টোর সঙ্গে আলাদা আলাদা দুটি সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পাঠক হয়তো জানেন, নানা কারণে সে সাক্ষাৎকার স্মরণীয় হয়েছে। ইন্দিরাকে অপগণ্ড, মূর্খ ইত্যাদি নানা কটু কথা বলার পর সে সাক্ষাৎকার ছাপা হলে বিপাকে পড়েন ভুট্টো।

সামনে সিমলা বৈঠক, ইন্দিরার মন-মর্জির ওপর নির্ভর করছে সে বৈঠকে ভারতে আটকে পড়া প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনার দেশে প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা। ওরিয়ানা তখন আফ্রিকার কোনো এক দেশে, সম্ভবত আদ্দিস আবাবায়। ভুট্টোর প্রতিনিধি ওরিয়ানাকে সেখানে খুঁজে বের করে তাঁর হাত-পা ধরে বললেন, ‘ভাই, তোমাকে বলতে হবে, ভুট্টো ও কথা বলেনি। তুমিই তাঁর কথা বুঝতে ভুল করেছ।’ সে কথা শুনে ওরিয়ানা তো রেগে আগুন। এই নিয়ে এরপর যে মহা কেলেঙ্কারি হয়, ওরিয়ানা নিজেই সে কথা সবিস্তারে লিখে গেছেন।
সেই একই সময়ে ওরিয়ানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর। ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামের বাইরে কাদের সিদ্দিকীর হাতে একজন রাজাকারের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখার পর এ নিয়ে একটি কঠোর প্রতিবেদন লিখেছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দেশে ফিরলে ওরিয়ানা আবার ঢাকায় আসেন। পরপর দুদিন ধরে তাঁর সাক্ষাৎকার নেন তিনি। পুরো সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে কোথাও দেখিনি, তাঁর বইতেও অন্তর্ভুক্ত করেননি ওরিয়ানা।
সাক্ষাৎকারসহ ওরিয়ানার দীর্ঘ প্রতিবেদনটি ছাপা হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ ইতালীয় পত্রিকা ল ইউরোপিওতে। কয়েক পাতাজুড়ে সে লেখা, সঙ্গে গোটা চারেক ছবি।
সম্প্রতি সে প্রতিবেদনের একটি কপি আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। এক ইতালীয় বন্ধুর সহায়তায় তা অনুবাদ করে পড়েও নিয়েছি। ফালাচির বদমেজাজ ও ঔদ্ধত্যের কথা আমরা জানি। কিন্তু যে ভাষায়, যে মনোভাবে এই সাক্ষাৎকারটি লেখা, তা আগের সব অভিজ্ঞতা ছাড়িয়ে যায়। ফালাচি বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছেন ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির সঙ্গে। তাঁকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, অহংকারী বলেছেন, এমনকি উন্মাদ পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করেননি। ২৬ মার্চ তিনি মারা না গিয়ে গ্রেপ্তার কেন হলেন, তার ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে ওরিয়ানা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর হয়তো কোনো গোপন আঁতাত থাকতে পারে। ওরিয়ানার প্রতিবেদন পড়ে মনে হয় বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত অসহিষ্ণু, ক্ষমতাদর্পী ও বদমেজাজের মানুষ। ওরিয়ানার বলা এই প্রতিটি কথাই বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে আমাদের জানাশোনা সব অভিজ্ঞতার পরিপন্থী। বঙ্গবন্ধুর এক ভাগনে, শমশের ওয়াদুদকে সাক্ষী দাঁড় করিয়ে ওরিয়ানা বলেছেন, ক্ষমতার লোভে লোকটা পাগল হয়ে গেছে। নিউইয়র্কে ‘নির্বাণ’ রেস্তোরাঁর মালিক—এই ভদ্রলোক সে সময় ঢাকায় গিয়েছিলেন মামার সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু তেমন একটা সুযোগ করতে পারেননি বলে বেজায় ক্ষিপ্ত ছিলেন। ওরিয়ানা নিজের বলা কথা যে ঠিক, তা প্রমাণের জন্য এই লোককেই বেছে নিয়েছিলেন সাক্ষী হিসেবে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আজ পর্যন্ত কোথায় কেউ এই নোংরা, কুৎসিত মিথ্যাচার নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি। অন্ততপক্ষে আমি দেখিনি, শুনিনি।
১৮ ডিসেম্বর স্টেডিয়ামে কাদের সিদ্দিকী প্রকাশ্যে একজন রাজাকারের বিচার করে তার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, এটি অবশ্য প্রতিষ্ঠিত সত্য। ওরিয়ানার লেখার সঙ্গে সে বিচারের একটি ছবিও আছে। টাইম ম্যাগাজিন ও অন্যান্য পত্রপত্রিকাতেও সে সময় এই ছবি ছাপা হয়েছিল। সন্দেহ নেই, ঘটনাটি ওরিয়ানাকে খুবই বিচলিত করেছিল। এটি একটি ‘ম্যাসাকার’—এই অভিযোগ তুলে তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে তার ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৮ ডিসেম্বর কোনো ‘ম্যাসাকার’ হয়নি, বঙ্গবন্ধু তাঁকে সে কথা বলার পরও ওরিয়ানা বারবার একই কথা বলতে থাকেন। কাদের সিদ্দিকীর করা বিচার তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, তার ছবিও রয়েছে তাঁর কাছে। কাদের সিদ্দিকীর নাম বলার পর বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন, হতে পারে কোনো রাজাকারের বিচার হয়েছিল।
ওরিয়ানা সে সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে খুবই অসদাচরণ করেছিলেন, তাঁর লেখাতেই সে কথা স্পষ্ট। রাষ্ট্রপতি ভবনে আরও কয়েকজন মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সামনে তাঁর আচরণ বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাকর্মীদের ভালো লাগেনি। ওরিয়ানা লিখেছেন, তাঁদের ক্রোধ এড়িয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন তিনি।
ইউরোপা পত্রিকার জন্য যে লেখাটি তিনি ডাকযোগে পাঠিয়েছিলেন, পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী তা ছাপা উচিত কি না, এ প্রশ্নে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের বিজয়ী রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু, শুধু নিজের দেশে নয়, সারা বিশ্বের মানুষের ভালোবাসার মালায় অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি। তাঁর নামে এসব কথা—তার সত্যাসত্য বিচার না করে কী করে ছাপানো যায়? অবশেষে কিঞ্চিত সম্পাদনা করে আপত্তিকর কথাগুলো কিছুটা কাটছাঁট করে লেখাটি ছাপার সিদ্ধান্ত হয়। মূল লেখার শুরুতে একটি সম্পাদকীয় টীকায় সে কথা জনানো হয়েছে।
প্রকাশের চল্লিশ বছর পর এ লেখার কি আদৌ কোনো মূল্য আছে?
আছে বৈকি! মুক্তিযুদ্ধের পরপর সদ্য স্বাধীন দেশে একজন বিদেশি সাংবাদিক, হোক না যত বৈরী মনোভাবাপন্ন, তার তৈরি এই প্রতিবেদন একটি ঐতিহাসিক নথিই বটে। যাঁরা সে সাক্ষাতের সময় কাছে ছিলেন, যাঁরা এ ঘটনার সঙ্গে পরিচিত, সত্যি কী ঘটেছিল তা খোলাসা করার দায়িত্ব তাঁদের। ওরিয়ানা লিখেছেন, প্রথম দিনের সাক্ষাতের পর তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথাযুদ্ধ হয়েছে, সে কথা ঢাকার প্রায় সবাই জেনে যায়, ফলে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। সত্যিই কি তাই? বেশ নির্বিঘ্নেই তো তিনি দেশ ছেড়েছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর ব্যাপারটিও নতুন নয়। লন্ডনে বসে যারা এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে, তাদের লেখাতে ব্লগ পোস্টে সে কথা এখনো প্রায় শোনা যায়। তবে এ কথাও ঠিক, বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত সে ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা শুনিনি। বাঘা সিদ্দিকী সে সময় বাংলাদেশের সরকারের অঘোষিত প্রতিনিধি হিসেবে সে বিচারকার্য পরিচালনা করেছিলেন, এ কথা যদি প্রমাণিত হয়, তা হলে একে বৈপ্লবিক বিচারকার্য বলা হবে না কেন? মোদ্দা প্রশ্ন হলো, কাজটা কি বেআইনি ছিল? চল্লিশ বছর পরও কি তার স্ট্যাচুট অব লিমিটেশন বহাল রয়েছে? আইন বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে লিখলে একটি বিতর্কের অবসান হয়।
একই লেখায় বেশ কয়েকটি ছবি রয়েছে। এই সাক্ষাৎকারের যদি কোনো ঐতিহাসিক মূল্য থেকে থাকে তো তা হলো এই ছবি। একটি ছবিতে দেখছি, বঙ্গবন্ধু পিতামহের নিবিড় স্নেহে আলিঙ্গন করছেন তার প্রপুত্রকে।
বেগম মুজিবের সঙ্গেও রয়েছে একই রকম একটি ছবি। সবচেয়ে মজার ছবিটি হলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র জয়ের। বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও উন্নাসিক এই প্রতিবেদনের জন্য ওরিয়ানা ফালাচি হয়তো আমাদের ক্রুদ্ধ সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্য হবেন। কিন্তু তার পরও আমি ওরিয়ানাকে ধন্যবাদ জানাই এই ছবি তিনটির জন্য।
আমার ইতিহাসের এক হারানো অধ্যায় তিনি ফিরিয়ে দিলেন, ধন্যবাদ সে কারণেই।
১৮ মার্চ ২০১২
নিউইয়র্ক।

No comments

Powered by Blogger.