৫ থেকে ২০ এপ্রিল ২০১২গ্যালারি: জলরঙ-দেশজ স্পন্দন by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

গ্রামীণ জীবনযাপনে শিকেয় তোলা মাটির হাঁড়ি এখন আর দেখা যায় না। সেই পূজা-পার্বণে বাড়ির উঠানে লতাপাতার নকশায় আঁকা আলপনা। লুপ্তপ্রায় শখের হাঁড়ি, সরাচিত্র, পুঁথি, পটচিত্রের গল্পভিত্তিক ছবির চর্চা—হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের এসব শিল্পকলার চর্চায় কিছু শিল্পী এখনো মগ্ন রয়েছেন।

এমন বিষয়কে ক্যানভাসে সাজিয়ে আধুনিক চিত্রশিল্পের সংশ্লেষে শিল্পসৃষ্টি করেন এমন সাতজন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে আগামী ৫ এপ্রিল গ্যালারি জলরঙে শুরু হচ্ছে ‘দেশজ স্পন্দন’ শিরোনামের প্রদর্শনীর। এসব শিল্পকর্মে উঠে এসেছে আমাদের শিকড়গন্ধি বিষয়। এসব শিল্পকর্মকে সাধারণত আমরা লোকজ শিল্প নামে অভিহিত করি। কিন্তু কোনোভাবেই এগুলোকে লোকজ শিল্প বলা যায় না। এ শিল্পের বিষয়ে উঠে এসেছে আত্মপরিচয়, শিকড় এবং অকৃত্রিম রং-রেখা। এটিই বাংলাদেশের মৌলিক শিল্প। সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষে শহুরে সমাজে নকশিকাঁথা, পিঠাপুলির নকশা, তালপাতার পাখাসহ নানা ব্যবহার্য সামগ্রীর উপস্থিতি দেখি। কিন্তু বাঙালির জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে থাকা এই ভূখণ্ডের শিল্প-ঐতিহ্য থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। আধুনিক ও বৈশ্বিক শিল্পনির্মাণের ধারায় হারিয়ে ফেলেছি আমাদের শিকড়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বংশপরম্পরায় লোকশিল্পের চর্চায় মগ্ন শিল্পীদের কাজের সঙ্গে লোকজ ফর্মকে বিষয় করে কাজ করেন এমন শিল্পীদের কাজের উপস্থিতি এ প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য। প্রাতিষ্ঠানিক রীতির বাইরে স্বশিক্ষিত শিল্পী ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিল্পকলার কৌশল রপ্ত করেছেন এমন সাতজন শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যম যেমন টেম্পারা, মিশ্রমাধ্যম, সরাচিত্র, এনামেল পেইন্টে আঁকা রিকশা পেইন্টিংয়ের আদলের কাজ প্রদর্শিত হবে।
এমন একজন তৃণমূল গোষ্ঠীর মানুষ আর কে দাশ। তাঁর বাবা ছিলেন একজন চর্মকার। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি পুরোনো ঢাকার নারিন্দায় রিকশা পেইন্টিংয়ে নিয়োজিত। তাঁর কাজের বিষয় বাংলার গ্রামীণ জনপদের সরল জীবনাচার। নদীতে কলসি কাঁখে রমণী, নদীর পানিতে বকের মাছ শিকারসহ চিরচেনা বাংলার নানা রূপ। পটশিল্পী রঘুনাথ বংশপরম্পরায় শিল্পচর্চা করে আসছেন। আধুনিক কিন্তু লোককলার বৈশিষ্ট্যে আলংকারিক নকশায় সমৃদ্ধ রঘুনাথের ক্যানভাস। তাঁর ছবিতে মানুষি দেহে জ্যামিতির উপস্থিতি ছন্দময় অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। আবদুশ শাকুর শাহ লোকগল্পের চরিত্রগুলোকে চয়ন করেন আধুনিক করণকৌশলে। কখনো গাঢ় জমিনের গায়ে শুধু রেখার টানে বিষয় তুলে আনেন। নাজির হোসেন ক্যানভাসে বিষয়কে তুলে আনেন রূপকল্প থেকে। রঙে লোককলার সন্ধান করে নকশিকাঁথার নকশার ফোঁড় তুলে আনেন নানা রঙের বিন্দু ও রেখায়। নিখিল নড়াইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেও শিল্পচর্চায় মগ্ন। গ্রামীণ জনপদের চেনা বিষয়গুলোকে তিনি লোকজ ঢঙে ক্যানভাসে উপস্থাপন করেন। সুশান্ত পাল রাজশাহীর বসন্তপুরে ছেলেবেলা থেকে শখের হাঁড়ি আঁকছেন। শখের হাঁড়ির গায়ে উৎকীর্ণ পাখি, ফুল আর মাছের নকশা ক্যানভাসে তুলে এনেছেন। সুকুমার পাল কাজ করছেন বংশপরম্পরায়। তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন দৈনন্দিন ব্যবহার্য কারুশিল্প তৈরির নকশায়। ঐতিহ্যবাহী এ কাজে এখনো তাঁর অভিনিবেশ রয়েছে। মাটির সরার গায়ে একরঙা প্রলেপ দিয়ে তার ওপর রেখা ও রঙে গড়ে তোলেন বিষয়ভিত্তিক শিল্পকর্ম। বাংলার শিকড়সন্ধানী সাতজন শিল্পীর এই বর্ণাঢ্য প্রদর্শনী চলবে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.