বাংলাদেশ বিমান-স্বচ্ছতা-দক্ষতাতেই নিশ্চিত বাণিজ্য

সুকুমার রায় 'হাঁসজারু' নামে এক অদ্ভুত প্রাণীর খবর দিয়েছিলেন। হাঁস ও সজারুর মিশ্রণে এমন এক প্রাণীর বাস্তবে অস্তিত্ব নেই বটে, কিন্তু কবির অলীক কল্পনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে 'হাঁসজারু' প্রাণীটিও। বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে হাঁসজারুর কথাই বিশেষভাবে মনে আসতে পারে।

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা থাকে। উন্নত সেবা, প্রতিযোগিতামূলক ক্রয়-বিক্রয় নীতি আর অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনা নীতি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মূলনীতি। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য গঠিত হয় এর আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, প্রাতিষ্ঠানিক পিছুটান ও রাজনীতিজনিত সুবিধা বণ্টনে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের অনেক সুবিধার দিক থাকলেও লোকসানটাই সবচেয়ে বড় অসুবিধা বলে গণ্য হয়। ফলে লাভজনক হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়ার তাগিদ এসেছে বিভিন্ন সময়ে। এতে সাড়া দিয়ে সরকার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দিয়েছে আবার কিছু প্রতিষ্ঠানকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দড়ি টানাটানিতে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে অনেকটা হাঁসজারুর মতো। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ বিমান অন্যতম। বলাবাহুল্য, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিচালনার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিমান পুনর্গঠন করা হলেও_ বাণিজ্য বাদে সবকিছুই হচ্ছে কিন্তু বাণিজ্য হচ্ছে না। লাভের জন্য নতুন ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা নীতি আয়ত্ত করা হয়েছে। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বেতনভাতা বিপুল পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, বেড়েছে অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বেতন কিন্তু লাভের দেখাই মিলছে না। শুধু যে লাভের দেখা মিলছে না তা নয়, বিমানকে রীতিমতো মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ২০০৯-১০ অর্থবছরে লোকসান ৮০ কোটি টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে লোকসান ১৯৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের লোকসান আমলে নিয়ে পরিমাণ এ বছরের শেষে দাঁড়াবে ৩০০ কোটি টাকার বেশি। গত তিন অর্থবছরে দেনার পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা থেকে ৬৮২ কোটি টাকায় ঠেকেছে। বিমানের এই বেহাল হিসাব দেখে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, বাণিজ্য করতে গিয়েই যদি এত লোকসান হয় তবে বাণিজ্য করতে না চাইলে কী হতো? বিমানের নাজুক অবস্থার পেছনে আছে বিমান নিয়ে সরকারের নীতিগত ভ্রান্তি, পরিচালকদের অদক্ষতা ও অযোগ্যতা। সারাবিশ্বেই বেসামরিক বিমান পরিবহন একটি লাভজনক খাত বলে গণ্য হয়। উন্নত সেবা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিশ্বের নামি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দেশ-বিদেশের সেবাগ্রহীতাদের আকৃষ্ট করছে, বাংলাদেশ বিমানের অবস্থান সেখানে পছন্দের তালিকায় শেষ দিকে। দৈনিকগুলোতে বিমান পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নানা অদক্ষতা, অযোগ্যতা, দুর্নীতি, অবৈধ সুবিধা গ্রহণের খবর নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে। কিন্তু সরকারের তরফে সচেতনতার বিশেষ আলামত মিলছে না। এ অবস্থায় বিমানের শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা বিমান বাঁচাও ঐক্য পরিষদ গঠন করেছেন। তারা দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলছেন। সবাই স্বীকার করবেন, বিমান যেভাবে লোকসানের পঙ্কে নিমজ্জিত তাতে দ্রুত একে উদ্ধার করা দরকার। তবে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত পদগুলোতে পরিবর্তন আনলেই সব সমস্যার সমাধান হবে কি-না সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। বিমানের সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে নীতি এ যাবৎ অনুসৃত হয়ে আসছে তাতে এসব পদে পরিবর্তন হলেও কোনো সরকারি কর্মকর্তারাই স্থানান্তরিত হবেন, যাদের বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। ফলে ভালো ফল মেলার সম্ভাবনা সুদূরপরাহতই থাকবে। এ অবস্থায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিকভাবে বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে একে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। নইলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় গুণে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ফল মেলার সম্ভাবনা নেই।

No comments

Powered by Blogger.