ঢাকাই হয়তো সাজিয়ে রেখেছে বিদায়মঞ্চ

ছোটবেলায় যখন সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরে পড়তেন আর ক্রিকেট খেলতেন, তখন টুকটাক ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। সেও এমন কিছু নয়। স্কুল ক্রিকেটে কোন ম্যাচে কত রান হলো, কটা উইকেট এল, এসবই টুকে রাখা! আর কখনো ডায়েরি লিখেছেন বলে জানা যায়নি।


অবশেষে শচীন টেন্ডুলকার আবার কাগজ-কলম তুলে নিলেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ যন্ত্রণাকাতর অস্ট্রেলিয়া সফরে এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে। ঢাকায় এশিয়া কাপের আগে এই ডায়েরির কটি পাতা খুঁজে পাওয়া গেছে, যার পুরোটাই কাল্পনিক, আসলে পবিত্র কুন্ডুর লেখা

২৬ ফেব্রুয়ারি, সিডনি, ২০১২
আজ শুরু থেকেই মাঝব্যাটে বল লাগছিল। ইচ্ছামতো শট খেলতে পারছিলাম। ভেবেছিলাম ৩০-৩৫ ওভার পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলে একটা তৃপ্তিদায়ী ইনিংস আসবে। কিন্তু হলো না। ওয়ার্নারের থ্রোতে রানআউট হলাম। ব্রেট লি স্ট্রাইক এন্ডে এমনভাবে পথ আটকে দাঁড়াল, গজ দুয়েক দূরে থাকতে ব্যাটটা ক্রিজে ছোঁয়াতে পারলাম না। আমার ক্ষেত্রেই কেন এমন হয়! সেই ১৯৯৯ সালে কলকাতা টেস্টে শোয়েব আখতারের বাধায় রানআউট হওয়ার কথাটা মনে পড়ল। এখানে সিডনিতে বাধা হলো ব্রেট লি। ভাগ্য আমাকে এবারের অস্ট্রেলিয়া সফরে বারবার বঞ্চিত করছে। ক্রিকেট-বিধাতা আমাকে নিয়ে কী এক রহস্যময় খেলা খেলছেন। সারা জীবন যে ক্রিকেট-বিধাতার পুজো করে এসেছি, তিনি কি মুখ তুলে তাকাবেন না!
সজ্ঞানে বলছি তৃপ্তিদায়ী ইনিংস, সেঞ্চুরির কথা নয়। অস্ট্রেলিয়ার ২৫৩ রানের লক্ষ্য ছুঁতে একটা ভালো ইনিংস দরকার ছিল। দলকে জেতাতে পারলেই আমি তৃপ্ত থাকতাম। আমার বুকে সব সময় ভারতের তেরঙাই আঁকা থাকে। সেঞ্চুরি কিংবা নিজের কোনো মাইলফলক নিয়ে আমি ভাবি না। ওগুলো নিছক সংখ্যা। বহুবার বলেছি, আমার শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি নিয়ে আমি নিজে ব্যগ্র নই। মানুষ ও মিডিয়ারই ওতে বেশি আগ্রহ।

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১২, হোবার্ট
আমাদের বোলিংকে একেবারে গলির ক্রিকেটের স্তরে নামিয়ে শ্রীলঙ্কা তুলে ফেলল ৩২০ রান। বোনাস পয়েন্টসহ ম্যাচটি না জিততে পারলে ফাইনালে ওঠার কোনো আশাই নেই। কিন্তু এই রানের পাহাড় টপকানো কি সহজ? বোলিংটা খুবই খারাপ হচ্ছে আমাদের। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, ওরা যেন শুধু হাত ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কোনো পরিকল্পনা নেই, উৎসাহ নেই। আমরা যে সেই ইংল্যান্ড থেকে টানা দুটি বিদেশ সফরে খারাপ করছি, এর পেছনে বোলিংয়ের দায় অনেক। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, বিশ্বখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপও ‘ক্লিক’ করেনি। আজ তো কিছু করতেই হবে। ৪০ ওভারের মধ্যে ৩২১ রানের পাহাড় টপকানোর চ্যালেঞ্জ ছিল বলে শুরু থেকেই চালিয়ে খেলেছি। বীরুকেও অনেক দিন পর চেনা লাগছিল। তার পরও ও ইনিংসটাকে টানতে পারল না। আমি যখন ৩৯ রানে, উঠল আম্পায়ারের আঙুল। এরপর ভাবিনি কঠিন লক্ষ্যটা ছোঁয়া সম্ভব হবে। কিন্তু বিরাট দুর্দান্ত খেলল। সত্যি বলছি, এ রকম ইনিংস আমার এই ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে খুব বেশি দেখিনি। ৮৬ বলে ১৩৩ নটআউট, আমরা ৩২১ রান চেজ করলাম মাত্র ৩৬.৪ ওভারে। ধন্যবাদ বিরাট, তোমার জন্য আমাদের আশা বেঁচে থাকল এখনো। ইশ্, কেন যে গোটা অস্ট্রেলিয়া সফরে আমরা এই ‘কিলিং ইন্সটিঙ্কট’ নিয়ে ব্যাট করতে পারলাম না!
ম্যাচটা যখন প্রত্যাশিত জয়ের আশা জাগাচ্ছে, মিডিয়া ম্যানেজার জিএস ওয়ালিয়া বার কয়েক আমার দিকে তাকালেন। জানি, কী এর অর্থ। এত দিন তুমি মিডিয়ার সামনে কথা বলোনি, আজ বলো! আমি তো বলব না। ওয়ালিয়ার দিকে তাই কয়েকবার অসম্মতির চাহনি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। সোজা কথা, আমি মিডিয়ার সামনে আসব না, যা বলার বলছে মাহি, বীরু ও গোতি। ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে, তবু যা বোঝার বুঝে নিন। মাঠে স্লো হয়ে গিয়েছি, দলের বোঝা হয়ে পড়েছি। তাই চলছে রোটেশন পলিসি!

২৯ ফেব্রুয়ারি, ব্রিসবেন, ২০১২
জানি, ফাইনালে ওঠার চাবিটা অস্ট্রেলিয়ার হাতে। তবু প্রথম ফাইনালের ভেন্যুতে আমরা চলে এলাম, যদি উঠি! টিভিতে অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা ম্যাচটি দেখলাম। শ্রীলঙ্কা আবার অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে মন ভেঙে দিল আমাদের। এখন ছুটে চলো মন বাড়ির দিকে! দুঃসহ যন্ত্রণার আর ক্ষরণের তিন মাসের অস্ট্রেলিয়া সফর শেষ। কিন্তু এশিয়া কাপে কি খেলা হবে আমার? যেভাবে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বের করছে ভারতের কোটি কোটি জনতা! এতে সুর মেলাচ্ছেন অনেক সাবেক তারকা। কপিল পাজি বলে দিয়েছেন, আমার অবসর নিয়ে ফেলাই ভালো। কিন্তু আমি জানি, রিচার্ড হ্যাডলির ৪৩১ উইকেটের বিশ্বরেকর্ড ভাঙতে কপিল কীভাবে দলে সেঁটে ছিলেন। সানি ভাই, রবি ভাইও ঠারেঠোরে বলে দিয়েছেন আমার শেষের চিন্তা করাই উচিত। সৌরভ বলেছে, আমার উচিত হবে এক দিনের ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেওয়া। আমার মনের মধ্যে একটা একলা আকাশ, পাথরচাপা কান্নার ভার। কিন্তু ঢাকার এশিয়া কাপটাকে যে আমি শেষ মঞ্চ হিসেবে ধরে রেখেছি! এখানে প্রমাণ করতেই হবে, ইয়ান চ্যাপেলরা যা বলছেন, তা ঠিক নয়। আমার ‘ফুট স্পিড’ এখনো যাচ্ছেতাই হয়ে যায়নি। আমি ভারতের জয় চাই, নিজের মাইলফলক নয়। এত যে রেকর্ড করলাম, কখনো তো ওটাকেই পাখির চোখ করে নামিনি!
আজ এশিয়া কাপের দল দিল। জানতাম, চিকা আমাকে বুঝবে। আমার প্রথম অধিনায়ক শিয়ালকোট টেস্টের সেই রক্তাক্ত দৃশ্যটা কি ভুলতে পারেন? ওই দৃশ্য থেকেই যে আমার ক্রিকেট-মানস তিনি বুঝে নিয়েছিলেন। এশিয়া কাপে আমি যাচ্ছি। এটা আমার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ পরীক্ষা। প্রতিপক্ষ সব দলই কঠিন। বাংলাদেশকেও দুধভাত মনে করলে ভুল হবে। বাংলাদেশের বিপক্ষে আমার কোনো ওয়ানডে সেঞ্চুরি নেই। যদিও ২০০৪ শ্রীলঙ্কা এশিয়া কাপে প্রায় সেঞ্চুরির কাছে গিয়েছিলাম (৮২*)। ঢাকাই হয়তো সাজিয়েছে আমার ওয়ানডের বিদায়ী মঞ্চ। বাংলাদেশের রাজধানীকে আমার বুকের মধ্যিখানে উজ্জ্বল একটা স্মৃতি করে রাখার চেষ্টা থাকবে। ঢাকাতেই আমি সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংসটা (২৪৮*) খেলেছি। আমি জানি, ওখানে যখন ব্যাট করতে নামব, ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতোই জনতা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাবে। আর আমি ক্রিজে দাঁড়িয়ে আকাশমুখো হয়ে খুঁজব আমার বাবাকে। বাবা, ওপর থেকে তুমি আশীর্বাদ করো! আমি যেন ওয়ানডের বিদায়বেলায় মানুষের ভালোবাসার মূল্য দিতে পারি। কত রান করলাম, কতগুলো সেঞ্চুরি—এসব দিয়ে বিচার না করে মানুষ যেন মনে রাখে, স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান একদিন এই ছেলেটির ব্যাটিংয়ে তাঁর ছায়া খুঁজে পেয়েছিলেন।

৮ মার্চ, ২০১২, মুম্বাই
আজ পত্রিকায় দেখলাম, রাহুল অবসরের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে। রাহুল, তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ। ভারতীয় ক্রিকেটে তোমার সঙ্গে অনেক উজ্জ্বল স্মৃতি আমার। একটা সময়ে সবাইকে থামতে হয়। তুমি আগে বিদায় বললে...আমিও বলছি, খুব দেরি হবে না। বিদায় বন্ধু! কালের যাত্রার ধ্বনি সবাই একসময় শুনতে পায়। তোমার শুভেচ্ছা আমার সঙ্গী হোক এশিয়া কাপে। কালের ধ্বনি যে আমিও শুনতে পাচ্ছি!

No comments

Powered by Blogger.