ইটস অ্যান এশিয়ান গেম! by মোস্তফা মামুন

এশিয়া কাপ ক্রিকেট কাহাকে বলে? উত্তর : যে প্রতিযোগিতার তারিখ কয়েকবার বদল হয় সাধারণত, যখন বা যে বছর হওয়ার কথা তখন হয় না, যাকে ঘিরে বয়কট-পাল্টা বয়কটের ঘটনা ঘটে, তারই নাম এশিয়া কাপ। ঠিক তাই। ১৯৮৪ সালে শুরু হয়েছিল দ্বিবার্ষিক প্রতিযোগিতা, সেই হিসাবে এই ২৮ বছরে ১৪টি টুর্নামেন্ট হয়ে এবার পঞ্চদশ আসর মাঠে


গড়ানোর কথা। কিন্তু এবারের এশিয়া কাপটি একাদশ। ইতিহাস ঘেঁটে দেখছি, শুরুর কয়েক বছর প্রতিযোগিতাটা খুব নিয়মিত ছিল এবং নিয়মিত গত কয়েক বছর, মাঝখানে নানা জটিলতার ফেরে পড়ে দুবার টুর্নামেন্টটা হয়েছে চার-পাঁচ বছরের বিরতিতে। এখন বাংলাদেশে সকাল-বিকেল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, তারকারা সব পাশের বাড়ির বদরুল-সদরুলের মতো আমাদের চেনা, কিন্তু একটা সময় এই এশিয়া কাপই ছিল আমাদের অন্ধের যষ্টি। আমরা খুব অপেক্ষা করে থাকতাম, কবে এশিয়া কাপ হবে? ভারত নিরাপত্তার অজুহাত তুলে পাকিস্তানে না যাওয়ার কথা বললে কিংবা পত্রিকায় শ্রীলঙ্কায় তামিল সমস্যার কারণে এশিয়া কাপ আয়োজনে সন্দেহ দেখা দিলেই টেনশন। বোধহয় গেল! এশিয়া কাপেই ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার সুযোগ, গাভাস্কার-ইমরানদের বিপক্ষে প্রিন্স-লিপু-নান্নুরা মাঠে দাঁড়াচ্ছেন ওদের সমান উচ্চতায়, সে ছিল আমাদের জীবনের রূপকথার বাস্তবতা। আর সেই কল্পনার ডানা কি না কেটে নিচ্ছে এসব রাজনীতি-কূটনীতি! খুব রাগ হতো। হতো বলে এই ধুন্দুমার ক্রিকেট সমারোহের সময়েও ঝাপসা স্মৃতি স্পষ্ট হয়। বঞ্চনার পুরনো স্মৃতি নতুন করে খোঁচা দেয়। সেই স্মৃতির পিঠ বেয়ে আবার উঠে আসে এশিয়া কাপে একাকার হয়ে থাকা আমাদের কিছু প্রাপ্তির পসরাও। ১৯৮৬ সালে এই এশিয়া কাপ দিয়েই তো বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল। এটাই তো সেই প্রতিযোগিতা, ১৯৮৮ সালে যা আয়োজন করে বাংলাদেশ জানিয়েছিল, আমরাও পারি। এশিয়া কাপ ক্রিকেট তাই যা-ই হোক, যেমনই হোক, আমাদের হৃদয়ের রং তাতে মিশে আছে। স্বপ্ননদীর বয়ে চলার শুরু তো এখান থেকেই।
এখন যেমন অনেকে মনে করেন, বিশ্বকাপ ক্রিকেট হলে পুরো দুনিয়া পাগল হয়ে থাকে, এশিয়া কাপ ক্রিকেট মানে পুরো এশিয়ার উত্তেজনা- এমন একটা ঘোর আমাদের মধ্যেও ছিল। ২০০০ সালে কেনিয়ায় নক আউট বিশ্বকাপ কভার করতে যাওয়ার সময়ও সেই ঘোর, সেই কল্পনাই ছিল সঙ্গী। পুরো দেশ নিশ্চয়ই আমাদের মতো উত্তেজনায় নাচছে। কিন্তু একি! হোটেলে আমাদের কাছে জানতে চায়, এত দূর থেকে কেন এখানে এলাম? ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জাতীয় টুর্নামেন্ট হচ্ছে শুনে একজন জানতে চায়, এই বিশ্বকাপে কারা কারা খেলবে? পরদিন স্থানীয় সাংবাদিক ডেরেক ওটিয়েনোর কাছে কথাটা তুলতেই ডেরেক বলল, এটা নিয়ে আমাদের মানুষের আগ্রহ থাকবে কেন? ইটস অ্যান এশিয়ান গেম।
এশিয়ান গেম!
হ্যাঁ, এখানকার এশিয়ানরাই তো খেলাটা শুধু খেলে!
ক্রিকেটের জন্ম এশিয়ায় নয়, শুধু এশিয়ানরা খেলে কথাটাও আংশিক সত্য, তাহলেও একটা দুনিয়া ধরে বসে আছে যে এটা এশিয়ার খেলা! তথ্যগতভাবে ভুল হয়তো, কিন্তু তথ্যের দেয়াল সরিয়ে বাস্তবতার চোখে দেখলে তো ঠিকই, এটা এক অর্থে এশিয়ান খেলাই তো! ইংল্যান্ডে ক্রিকেট মানে এখন প্রবীণ সংঘের মানুষের সময় কাটানোর জায়গা, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকায় জনপ্রিয় খেলা যদিও কিন্তু জনপ্রিয়তম তো নয়। ক্রিকেটের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক একটা খেলার সঙ্গে যেমন সম্পর্ক থাকে তেমনটাই। আবেগ নেই, সংস্কৃতিতে ঢুকে নেই, জীবনাচরণের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেনি। এখানে হয়েছে। ভারতে এবং বাংলাদেশে জীবনেরই ছবি খুঁজে পাওয়া যায় ক্রিকেটে। অতটা না হলেও পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কায়ও অপ্রতিরোধ্য এক নম্বর ক্রিকেট। কিন্তু এই যে দেশগুলোর কথা বললাম, সেগুলো তো পুরো এশিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এশিয়ারও আরো অনুল্লেখযোগ্য, আরো পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ এশিয়া। একদিক থেকে চিন্তা করলে তো এটা আসলে দক্ষিণ এশিয়ান কাপ। কয়েকটা আসরে সহযোগী সদস্য দেশগুলোকে যোগ করে একটা এশিয়ান অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। হাস্যকরভাবে ব্যর্থ। হংকং-আরব আমিরাতরা শক্তিতে এত পেছনে যে ওদের ক্রিকেট লোককে হাসানো পর্যন্তই। তাই অগত্যা এশিয়া কাপ মানে দক্ষিণ এশিয়া কাপই এবং এটা আর একটা ত্রিদেশীয় বা চারদেশীয় সিরিজের মতোই প্রতিযোগিতা যেন। এই রূপসজ্জার যুগে যখন রূপহীনকেও অপরূপ প্রমাণের চেষ্টা চলে, প্রচার-প্রোপাগান্ডায় কানা ছেলেকেও পদ্মলোচন বানিয়ে ফেলা যায়, সেখানে আমাদের এশিয়া কাপ বড় দুর্ভাগা। যে অংশটা পৃথিবীতে খেলাটাকে ধরে রেখেছে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতাটা যেন নিছকই একটা টুর্নামেন্ট মাত্র। এর বেশি কিছু নয়।
কিছুদিন পর শুরু হবে ফুটবলের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ। দেখবেন, তার কিছুদিন আগে থেকেই ইউরোপিয়ানরা ঢোল বাজানো শুরু করবে, 'এই টুর্নামেন্ট বিশ্বকাপের চেয়েও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ', 'এখানে যে খেলা হয় তার মান অনেক উঁচু।' ওদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলা উত্তেজনায় বিশ্বকাপের চেয়ে এগিয়ে, এই কথাটা নামকরা কোচেরা এই গত বিশ্বকাপের সময়ও বলেছেন। ইউরোপিয়ানরাও বিশ্বকাপ খেলে, তবু নিজেদের টুর্নামেন্ট নিয়ে তাদের এই আওয়াজ কেন? আসলে এই স্লোগানে ওরা বোঝাতে চায়, ফুটবল ইউরোপের খেলা। এই খেলার নেতৃত্বের অধিকার আসলে তাদেরই। ঠিক সে রকম স্লোগান তো এশিয়া কাপের আগেও ওঠা উচিত, যখন এটা প্রায় প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট এখন তীর্থ বদলে এশিয়ায় জায়গা নিয়েছে। কিন্তু হায়, আমাদের এশিয়া কাপের এমন কোনো ঢোলক নেই। কেউ বলে না যে এটা এশিয়ার বিশ্বকাপ। আধুনিক ক্রিকেটের লালনভূমিগুলো মিলিত হচ্ছে এখানে, এমনভাবে বিশেষায়িত হওয়ার সুযোগও জোটে না এশিয়া কাপের ভাগ্য। বিশ্বকাপের কিছু ধুয়া অবশ্য তোলা হয়েছিল। কিন্তু কোলের বাচ্চারও টিকিট লাগবে, এটা নিয়ে মাঠে ঢোকা যাবে না- এই জাতীয় মানুষকে হেনস্তা করার ক্ষেত্রগুলোতেই শুধু টুর্নামেন্টের বড়ত্বকে ব্যবহার বা অপব্যবহার করা হয়েছে। এর বাইরে এশিয়া কাপের বাজনা বড় ক্ষীণ। পোস্টার নেই, আলোকসজ্জা নেই, মাত করা বিজ্ঞাপন নেই! না। এশিয়া কাপ বড় দুর্ভাগা টুর্নামেন্ট।
এশিয়া কাপের কপালে যখন এমন অবহেলা তখন কানে বাজে সেই কথাটা। ইটস অ্যান এশিয়ান গেম! ১২ বছর আগে অখ্যাত কেনিয়ান সাংবাদিক কথাটা বলেছিলেন তাচ্ছিল্য করে, কিন্তু এশিয়া কাপ শুরুর এই লগ্নে সেটাই হয়ে যাচ্ছে গর্বের সুর। আর এশিয়া কাপের স্বাগতসংগীতে আনন্দের সুর বয়ে আনে এই স্মৃতিগুলো, এখানে খেলেই আমরা পেয়েছিলাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পথের দেখা...এটা আয়োজন করেই আমরা দেখিয়েছিলাম...।
ক্রিকেট এশিয়ার খেলা। আর এশিয়া কাপ বাংলাদেশের যাত্রারম্ভের ভেলা।

No comments

Powered by Blogger.