জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসমূহঃ তাদের কাজের পরিপ্রেক্ষিত এবং মূল্যায়ন by শাহ আবদুল হান্নান


বিশ্বের প্রত্যেক দেশেই গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে, বিশেষ করে প্রধান প্রধান দেশে। তারা যেমন পুলিশের সঙ্গে থেকে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন করে, তেমনি অন্য কিছু গোয়েন্দা সংস্থা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে থাকে। এরা সবাই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বহিঃনিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখে এবং সরকারকে নিয়মিত রিপোর্ট দেয়।
সরকারপ্রধান এসব সংস্থা থেকে আলাদা আলাদা রিপোর্ট পান এবং তার পক্ষে সম্ভব হয় একটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবস্থা বুঝে নিতে। একথা সত্য যে, এসব নিরাপত্তা সংস্থার কোনো কোনোটি কোনো কোনো দেশে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করে এবং এক্ষেত্রে অনেক বাড়াবাড়িও করে। এ দায়িত্বটি এসব গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব হওয়া উচিত কিনা এটি একটি বিতর্কিত বিষয়। বাংলাদেশে এ বিষয়ে যে অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। হয়তোবা সব সময়ই কিছুটা হয়েছে, কিন্তু কেয়ারটেকার আমলে জেনারেল মইনের সময় যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় তা ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকে এবং অন্য ব্যক্তিবর্গকে শুধু শোনা কথা বা জনশ্রুতির কারণে এমনকি গ্রেফতার না করে এবং কোর্টকে না জানিয়ে মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় এবং অকথ্য, অসহ্য এবং অবিশ্বাস্য নির্যাতন করা হয়। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে গ্রেফতার করার পর রিমান্ডে নেয়া হয়। এখানে একটি বিষয় বিশেষ করে নজরে আনার উদ্দেশে আমি লিখছি সেটা হচ্ছে, এতসব কুকাণ্ডের পরও গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া উপায় নেই এবং সরকারের নির্দেশে গোয়েন্দা সংস্থাকে এমন কিছু কাজ করতে হয়, যা প্রকাশ করা যায় না। উদাহরণ হিসেবে, সিআইএ, কেজিবি, র, আইএসআই অনেক কিছু করে, যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না এবং তা সম্ভবও নয়। তাদের অনেক সময় অন্যদের অস্ত্র দিতে হয়, ট্রেনিং দিতে হয় এবং এসবই হয় জাতীয় স্বার্থে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এগুলো বোঝা কঠিন। এগুলো যে সব সময় নৈতিক মানে উত্তীর্ণ হয় তাও বলব না, কিন্তু এটাই বিশ্ব বাস্তবতা।

এখন আমি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা বলব। আমরা সবাই জানি চট্টগ্রামে যখন বিদ্রোহ দেখা দেয় তখন সেখানে অনেক লোক ভারতে চলে যায়। ভারত তাদের আশ্রয় দেয়, খাবার দেয়, এটা যেমন সত্য, তেমনিভাবে এটাও সত্য তারা তাদের ট্রেনিং দেয়। তাদের অস্ত্র দেয় এবং অস্ত্রসহ তাদের বাংলাদেশে প্রেরণ করে, তাদের নেতাদের ভারতে রাখে এবং অন্য সবাইকে সাহায্য করে। এ ধরনের কাজ আইএসআইকে করতে হয় কাশ্মীরের ক্ষেত্রে, সিআইএকে করতে হয় কিউবার ক্ষেত্রে, ন্যাটোকে করতে হয় বসনিয়া যুদ্ধের সময় ইত্যাদি। এতসব জানার পর, উলফার কিছু নেতার বাংলাদেশে অবস্থান এবং কয়েক ট্রাক তথাকথিত অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে ভারতের পত্র-পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির কি যুক্তি আছে? সরকারইবা কেন এসব বিষয়ে মামলা দায়ের করবে। এসব বিষয় যদি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে কেউ করে থাকে তবে তাতো প্রকাশ করার বিষয় নয়, মামলা করার বিষয় নয় এবং প্রকাশ্যে তদন্ত করার বিষয়ও নয়। যদি তদন্ত করতে হয় এবং যদি কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করে থাকে তবে তাতো গোপনেই করতে হবে।
আমি বুঝতে পারছি না বর্তমান কর্তৃপক্ষ কী সব নিয়মনীতি ভুলে গেছে, জাতীয় স্বার্থ কী ভুলে গেছে, এ ক্ষেত্রে স্বীকৃত নিয়মনীতি কী ভুলে গেছে। আমার মনে হয়, সরকারের একটি অংশের দুর্বলতাই এসবের কারণ। এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এভাবে এসব কাজ চলে না। বাংলাদেশের অনেক জাতীয় স্বার্থ আছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যা আছে। সুতরাং ভবিষ্যতে কী হবে আমরা বলতে পারি না। আমাদের হাতকে খোলা রাখতে হবে, জাতীয় স্বার্থে যখন যা দরকার তা করতে হবে, কোনো চুক্তির মাধ্যমে আমরা আমাদের হাতকে বন্ধ করে রাখতে পারি না। কেউ চিরবন্ধুও নয়, আবার কেউ চিরশত্রুও নয়। আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে সরকারের সাবেক সচিব হিসেবে একথাগুলো নিবেদন করতে বাধ্য হলাম। আশা করি তারা এ লেখার সুঅর্থ গ্রহণ করবে, ভুল অর্থ নয়।
লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব

No comments

Powered by Blogger.