গহন গহীন-রাশিয়ায় আবার পুতিন-পর্ব শুরু by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

২০১২ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে নির্ধারিত সোভিয়েত রাশিয়ার নির্বাচনের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে পদ পরিবর্তন করে তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে রাশিয়ানদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।


ক্ষমতার শীর্ষে থাকা দুই নেতার পর্যায়ক্রমে অবস্থান বদলকে তাঁরা দেখছেন 'ইঁদুর-বিড়াল খেলার' মতো। আশির দশকে 'পেস্ত্রোইকা' (যার আক্ষরিক অর্থ পুনর্নির্মাণ)-পরবর্তী সময়ে যখন মতামত প্রদানে আগের মতো বিধিনিষেধ নেই, তখন সমালোচনা যে হবে এটা তো জানা কথা। একদা যা ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএসআর), পশ্চিমা বিশ্বের ধারণায় যে দেশটি ছিল লৌহ যবনিকার অন্তরালে, যেখানে সামান্যতম বিরুদ্ধ মতটিকে পিষ্ট করা হতো কঠোর শক্তি প্রয়োগের দ্বারা, সেই দেশটিতে মতপ্রকাশের বিধিনিষেধ অপসৃত হয় ১৯৯১ সালের দিকে। দেশটির গোড়াপত্তনের পর ১৯২২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনামলের পর পেস্ত্রোইকার কল্যাণে ভিন্ন মতের উচ্চারণও শোনা যেতে লাগল। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পত্তনের পর ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টি আর কমিউনিস্টবিরোধী হোয়াইট মুভমেন্ট ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলো। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতার লড়াইয়ে জয় হলো লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টির। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পরবর্তী কয়েক মাসে একত্রীভূত হয়ে রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক ট্রান্স-ককেশিয়ান সোশ্যালিস্ট ফেডারেটিভ সোভিয়েত রিপাবলিক, ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক ও বাইলোরাশিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের সংযুক্তির ফলে স্থাপিত হলো বিশাল রুশ সাম্রাজ্য। শুধু বিশাল একটি রাষ্ট্রই ছিল না ইউএসএসআর, ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শ আর প্রভাবশালী কমিউনিস্ট আদর্শের একটি দেশ। বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়ল মোটা দাগে_সোভিয়েত প্রভাব বলয় আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ধনতান্ত্রিক আদর্শ বলয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান দৃঢ়ভিত্তিক হলো বিপ্লব-পরবর্তী সময় থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে। 'দুনিয়ার মজদুর এক হও'_এই স্লোগানের মূলমন্ত্রে মহামতি লেনিন বিশ্বের নিপীড়িত, নিগৃহীত মানুষকে কাস্তে-হাতুড়ে সজ্জিত লাল পতাকার তলে সমবেত করলেন। ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি লেনিনের মৃত্যুর পর ক্রেমলিনে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হলেন 'লৌহমানব' জোসেফ স্টালিন (জন্ম : ১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৮_মৃত্যু ৫ মার্চ, ১৯৫৩)। রুশ বিপ্লবের অগ্রভাগে থাকা অন্যতম সেনানী স্টালিন ইতিহাসে একজন নির্দয়, পরমত দলনকারী লৌহহৃদয় মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। স্টালিন শুধু যে সোভিয়েত রাশিয়াকে শক্ত ও সংহত অবস্থানের ওপর দাঁড় করান, তা নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশটির অবস্থানও দৃঢ় করেন। আপন ক্ষমতা সংহত করার জন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের কঠোর হাতে দমন করলেন। সাইবেরিয়ার হিমাঙ্কের নিচে আবহাওয়ায় স্থাপিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ভরে উঠল ভিন্নমতাবলম্বীদের দ্বারা। রুশ সেনাবাহিনী রেড আর্মিকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত করে নিজের দেশের প্রভাব বলয় বিস্তৃত করলেন পূর্ব ইউরোপে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে দেশকে নেতৃত্বদানের কৃতিত্বের দাবিদার জোসেফ স্টালিন আগেই বলেছি রুশ সেনাবাহিনী রেড আর্মিকে বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী বাহিনীতে পরিণত করেন। পূর্ব ইউরোপে, বিশেষ করে বার্লিন জয়ে রেড আর্মির ভূমিকা অনন্য ও ঐতিহাসিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দুই শিবিরের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে একপক্ষে নেতৃত্বে দেন সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি জোসেফ স্টালিন। অন্যপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট। 'ঠাণ্ডা লড়াইয়ে' দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল পৃথিবী। ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ স্টালিনের মৃত্যুর পর ক্রেমলিনের ক্ষমতা লাভ করলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ (জন্ম : ১৫ এপ্রিল, ১৮৯৪_সেপ্টেম্বর ১১, ১৯৭১)। ক্ষমতা গ্রহণের পর স্টালিন আমলের নির্যাতনমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন ক্রুশ্চেভ। সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তাঁর আমলে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। নানা রকম বৈপরীত্যের জন্য তাঁর আমল রাশিয়ার ইতিহাসে এক বিতর্কিত আমল। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল এ সময়ে একজন প্রাজ্ঞ কূটনীতিকের চেয়েও বেশি অর্থবহ 'শাটল ডিপ্লোম্যাসি' করে বিশ্বকে যুদ্ধংদেহী দুই পরাশক্তির রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। প্রায় অনুরূপকালে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষে রাসেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ বন্ধ করতে পারেননি। এর জন্য একসময়ে তিনি সখেদে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর একগুঁয়েমিকে দায়ী করেছিলেন। বিশ্বরাজনীতিতে নিকিতা ত্রুদ্ধশ্চেভ একজন উগ্র মেজাজি ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত। প্রচলিত আছে, ১৯৬০ সালের ১২ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৯০২তম প্ল্যানারি অধিবেশনে সোভিয়েত এই নেতা ফিলিপাইনের প্রতিনিধি লরেঞ্জো সুমুলংয়ের অভিযোগে উত্তেজিত হয়ে টেবিলে তাঁর জুতো চাপড়েছিলেন। লরেঞ্জোর অভিযোগ ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপকে 'গিলে খেয়েছে' এবং জনগণকে মৌলিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখছে। অবশ্য ক্রুশ্চেভের জুতা-চাপড়ানো ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য ভিডিও কিংবা অডিও রেকর্ডে পাওয়া যায় না। একটি অনির্ভরযোগ্য ছবির ওপর নির্ভর করে এই অভিযোগ আনা হয়। ১৯৬৪ সালের ১৪ অক্টোবর রুশ প্রেসিডিয়াম ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে ক্রুশ্চেভের 'স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ'-এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং মাসিক ভাতা ৫০০ রুবল ও একটি বাসস্থানসহ তাঁকে অবসরজীবনে পাঠানো হলো। এরপরে ক্রেমলিনে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন লিওনিদ ব্রেজনেভ (জন্ম : ১৯ ডিসেম্বর, ১৯০৬_মৃত্যু : ৬ নভেম্বর, ১৯৮২) আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্রুশ্চেভের স্থলাভিষিক্ত হলেন আলেক্সি কসিগিন (জন্ম : ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪_মৃত্যু : ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৮০)। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে মিখাইল গর্বাচেভের সময় সূচিত পেস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্তের (মুক্তনীতি, প্রচারে স্বচ্ছতা) ফলে রুশ সাম্রাজ্যে ভাঙন দেখা দিল। একদা রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির অফিসার ভ্লাদিমির পুতিন (জন্ম : অক্টোবর ৭, ১৯৫২) আগেই বলা হয়েছে বেড়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের রাজনৈতিক ছায়ার নিচে। ইয়েলৎসিনের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভের সমর্থক হিসেবে শুরু হলেও রাশিয়ায় পেস্ত্রোইকার নামের পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ক্ষমতার লড়াইয়ে মিখাইল গর্বাচেভের পদত্যাগ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর (২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১) ইয়েলৎসিন রাশিয়ান ফেডারেশন নামে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন। একদা যে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ক্ষমতাধর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, তার এই পরিণতি সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম চমকপ্রদ ঘটনা। ইয়েলৎসিন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থারও প্রবর্তন করেন তিনি। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে এবং আকস্মিকভাবে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করলেন প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন। নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনয়ন দিলেন তাঁরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনকে। ইয়েলৎসিন যখন ক্ষমতা ছাড়েন, তাঁর জনপ্রিয়তা তখন তলানিতে। দুই শতাংশ মানুষ তখন ছিলেন তাঁর পক্ষে_এমন ধারণা বিশ্বরাজনীতির বিশ্লেষকদের।
শুরু হলো রুশ রাজনীতিতে পুতিন-পর্ব। তাঁর এই আকস্মিক ক্ষমতা গ্রহণে রুশরা শুধু নন, বিশ্ববাসীও সেদিন চমকিত হয়েছিলেন। কিভাবে তাঁর এই উত্থান ঘটেছিল, তার কারণ এখনো অনির্ণীত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০০ সালে প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৪ সালে পুনর্নির্বাচনে জয়ী প্রেসিডেন্ট পুতিন শাসনতান্ত্রিক বিধিনিষেধের কারণে সরাসরি তৃতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পেরে ক্ষমতাহীন প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে চার বছরের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে পদ পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর কার্যত যদিও তৃতীয়বার নতুন করে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছেন, যা রুশবাসী পছন্দ করেনি। ইতিমধ্যে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দল ইউনাইটেড রাশিয়া পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই নির্বাচন রুশ ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত নির্বাচন হিসেবে গণ্য। বিরোধী দল কমিউনিস্ট পার্টি এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি এখনো। প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন রাশিয়ার স্বচ্ছতর নির্বাচনের মাধ্যমে, যে নির্বাচনে ভোট প্রদানের প্রক্রিয়া ছিল ইলেকট্রনিক ক্যামেরা নেটওয়ার্কের আওতায়!
লেখক : অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.