আইলাবিধ্বস্তদের খবর কে রাখেঃ খোলা আকাশের নিচে শীতার্ত জীবন


৮ মাস পরও দক্ষিণাঞ্চলের আইলাবিধ্বস্ত এলাকার মানুষের জীবন হাহাকারেই ভরে আছে। এরই মধ্যে মন্ত্রীরা ঘুরে গেছেন, সেনা-নৌবাহিনী প্রধান আশ্বাস দিয়ে গেছেন। সরকারদলীয় স্থানীয় এমপি জাতীয় সংসদে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ সাহায্যের কথাও কারও অজানা নেই।
সবই মিডিয়ার কল্যাণে ফলাও প্রচার পেয়েছে। কিন্তু এসব কিছুতে দুর্গত মানুষের দুর্দশা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গতকালের আমার দেশ-এ প্রকাশিত খুলনা প্রতিনিধির পাঠানো আইলাবিধ্বস্ত জনপদের রিপোর্ট থেকে সে ধারণাই পাওয়া যায়। বিশেষ করে দাকোপ, কয়রা, শ্যামনগর উপজেলার লাখ লাখ মানুষের জীবন এখনও দুর্দশায় ভারাক্রান্ত। দাকোপের অসংখ্য গ্রামে পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে সেখানকার অধিবাসী। জোয়ারের ৪-৫ ফুট লোনা পানিতে দিনে দু’বার তলিয়ে যায় এসব গ্রাম। এখানকার মানুষ রাস্তার পাশে টংঘর বা মাচায় দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। শীতের হাড় কাঁপানো বাতাস তাদের জীবনের উত্তাপটুকুও কেড়ে নিতে চায়। আইলার আঘাতে মৃতের সংখ্যার চেয়ে দুর্যোগ-পরবর্তীকালে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। নদী তীরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত না হওয়ায় জোয়ার-ভাটার টানে বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হওয়ার মুখে। পোল্ডারের ৭টি ক্লোজার মেরামত ও সংস্কারে ঠিকাদাররা এগিয়ে না আসায় পানি উন্নয়ন বোর্ডও অসহায়। গত বর্ষা মৌসুমের আগে কাজের বিনিময়ে ত্রাণের চাল কর্মসূচির অধীনে স্থানীয় জনগণ দু’মাইল দীর্ঘ রাস্তা মেরামত করায় প্রায় ১০ হাজার বিঘা জমি জলাবদ্ধতামুক্ত হয়েছে। অথচ সে কাজের ২শ’ মেট্রিক টন চাল এখনও পাওনা রয়ে গেছে। বর্ষার শেষে বাঁধের কাজ শুরু না হওয়ায় এখন সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। শীতের শেষে ফাল্গুনের বাতাস শুরু হলে পানির তোড়ে আর কিছু করা সম্ভব হবে না। ফলে আগামী বর্ষায় উপজেলার অনেকটাই তলিয়ে যাবে নদীর পানিতে। এ আশঙ্কা অবাস্তব নয়।

একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী কয়রা, শ্যামনগর প্রভৃতি উপজেলারও। আইলার আঘাতে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার সেখানকার জনগণ। স্থানীয় উদ্যোগে তৈরি বাঁধ বার বার ভেঙে গেছে জোয়ারের আঘাতে। তাই লাখ লাখ মানুষের উদ্বাস্তু জীবনই যেন স্থায়ী হতে চলেছে। অনিয়মিত নামমাত্র ত্রাণের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা চোখে না দেখলে কল্পনা করা কঠিন। সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায় থেকেই চাহিদামত সহায়তা না পেয়ে অনেকেই শহরমুখো হয়েছেন। বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত সাহায্য কোনো কোনো স্থানে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে। জনৈক মন্ত্রী পরিচালিত এনজিও সম্পর্কে এমনই অভিযোগ উঠেছে। তাদের পক্ষ থেকে পরিবারপ্রতি যে ক্যাম্বেল হাঁস দেয়া হয়েছিল, সেগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়া ডাকপ্লেগে শুধু ওগুলোই মরেনি, অন্য হাঁস-মুরগিও উজাড় হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দেশব্যাপী বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণে সরকার সাফল্য দাবি করলেও আইলাবিধ্বস্ত এলাকায় বই দূরে থাক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই ফাঁকা পড়ে আছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত্ অন্ধকার। সেখানকার মানুষ যেমন ভিটেবাড়িতে উঠতে পারছে না, তেমনই জমিতে চাষাবাদ করতে পারছে না লবণাক্ত পানি জমে থাকায়। পুরো এলাকায় পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, সুপেয় পানি নেই, বিদ্যুত্ নেই, ডায়রিয়া প্রতিরোধে খাবার স্যালাইনও পাওয়া যায় না। এমনই অবস্থায় মহাজোট সরকারের বছরপূর্তি উপলক্ষে সাফল্য দাবি আইলাদুর্গতদের দুঃখ-দুর্দশাকে উপহাস করারই শামিল।
গত বছরের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ উপকূলীয় জনপদ তছনছ হয়ে যায়। ভয়ঙ্কর সিডরের পর আইলায় কূলহারা উপকূলবাসীর দুর্দশাকে চরম করে তোলে। মহাজোট সরকারের এক বছরে তাদের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে—এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। খোলা আকাশের নিচে আইলাদুর্গত মানুষের শীতার্ত-অভুক্ত জীবনের শেষ কবে হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.