কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ-পপুলার লাইফের পরিচালকেরা অর্থ পাচার ও আত্মসাতে লিপ্ত by ফখরুল ইসলাম

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও পরিচালকেরা অর্থ পাচার ও আত্মসাতে লিপ্ত। জাল দলিলের মাধ্যমে তাঁরা ৪০৪ কাঠা সরকারি জমি জবরদখলের পাঁয়তারা করেন।


পপুলার লাইফের উদ্দেশে লেখা বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (ইডরা) চিঠিতে এ কথা বলা হয়েছে। চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট প্রতিষ্ঠান নুরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কোম্পানির (এনইউএফএইচএএস) এক তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে চিঠিটি তৈরি করেছে ইডরা। তদন্ত করতে এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ দেয় ইডরা।
৭ মার্চ পপুলার লাইফের চেয়ারম্যান এম এ রশিদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বি এম ইউসুফ আলী ও আট পরিচালককে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে ইডরা। অন্য পরিচালকেরা হলেন: সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ভাই আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী, মোহাম্মদ আক্তার পারভেজ চৌধুরী, কবির আহমেদ, মো. আক্তারুল হক, আসিফ রহমান, মোহাম্মদ শোয়েব, মোতাহার হোসেন ও সাইদুল ইসলাম।
রাজধানীর গুলশানের কড়াইল এলাকার এ সম্পত্তি ১৯৫৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) নামে অধিগ্রহণ করা। বর্তমান বাজারে এর দাম আড়াই হাজার কোটি টাকা। তবে জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজে-কলমে এর দাম নির্ধারণ করা হয় ২৯৪ কোটি টাকা।
নোটিশে ইডরা বলেছে, ‘১১৮ কোটি টাকা এবং কথিত সম্পত্তি কেনার তারিখ থেকে বার্ষিক ১২ শতাংশ সুদসহ কোম্পানির খাতে জমা দিতে কেন আপনাদেরকে বলা হবে না, আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তা দর্শাতে হবে। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত শুনানি চান কিনা তাও জানাতে হবে।’
তদন্ত প্রতিবেদন: তদন্ত প্রতিবেদনে বিটিসিএলের সম্পত্তি জবরদখল করতে ভুয়া দলিল করার তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। বলা হয়, সম্পত্তি নিজেদের নামে লিখিয়ে নেওয়ার আগেই কোম্পানি জানত যে তা বিটিসিএলের। কারণ, কোম্পানির আইনগত উপদেষ্টা শহিদুল ইসলাম জমিটি না কেনার জন্য মতামত দিয়েছিলেন। এ ছাড়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বানোয়াট দলিলের মাধ্যমে ১১৮ কোটি টাকা নাম-ঠিকানাবিহীন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বরাবর পরিশোধ দেখান। মৃত ফজলুল করিমের স্থায়ী ঠিকানা দেখানো হয় ঢাকার নীলক্ষেতে। অথচ তাঁর প্রকৃত স্থায়ী ঠিকানা শরীয়তপুরের গোপালপুরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৯৪ কোটি টাকার মধ্যে বিক্রেতা পেয়েছেন মাত্র ৯১ কোটি টাকা। ২০৩ কোটি টাকা তাঁদের দেওয়া হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যজনক যে দুই বছর পার হলেও বিক্রেতারা ওই টাকা দাবি করেননি বা আদায়ের পদক্ষেপও নেননি।
আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন: আইন মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে একটি তদন্ত করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯১ কোটি টাকা মূলত ভাগাভাগি হয়েছে। এর মধ্যে নাজমা বেগমকে দেওয়া হয় সাড়ে ১৩ কোটি। আলী আকবর খান ও হোসাইন মামুন পান ১০ কোটি টাকা করে। এ ছাড়া রিচি অটোমোবাইল সাড়ে ১৩ কোটি, লেক্সাস ভিশন ছয় কোটি, মনজুর আহমদ তিন কোটি, গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তিন কোটি ও বাচ্চু মিয়া আড়াই কোটি টাকা পান। ভাগাভাগি হয় আরও সাড়ে ২৯ কোটি টাকা। অথচ পপুলার ইনস্যুরেন্স নাজমা বেগমের কাছ থেকে লিখিত নেয় যে ৯১ কোটি টাকা তিনি বুঝে পেয়েছেন।
মতামত ও বক্তব্য: তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শামীম খালেদ আহমেদ ইডরাকে মতামত দেন যে ‘এই মুহূর্তের ইডরার করণীয় হবে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিতর্কিত জমি কেনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এবং অজানা ব্যক্তির কাছে টাকা পরিশোধ বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করা এবং ওই টাকা কোম্পানির তহবিলে জমা করানোর জন্য বাধ্য করা। এ ছাড়া বিচারাধীন মোকদ্দমার অজুহাত দেখিয়ে কোম্পানির টাকা ফেরতের বিষয়টি বিলম্বিত করার কৌশল যেন কোম্পানির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা করতে না পারেন, তার প্রতি দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন হবে।’
যোগাযোগ করলে পপুলার লাইফের পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ফোনে অনেক কথা বলা যায় না। সামনাসামনি হলে তিনি বিষয়টি বোঝাতে পারতেন যে তাঁরা ঠিক পথেই আছেন। তিনি বলেন, জালিয়াতির প্রশ্নই ওঠে না, বরং এক সময় এই সম্পত্তি কোম্পানির নামেই আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
পপুলার লাইফের বড় গ্রাহক হিসেবে পরিচিত তফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে পরিচালকদের এসব কর্মকাণ্ডে তিনিসহ অন্যরা খুবই উদ্বিগ্ন।
ইডরার চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল পরিমাণ পলিসি গ্রাহকের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। তবে ইডরা আইনানুযায়ী যেকোনো অসাধু কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেবে।

No comments

Powered by Blogger.