বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খুন : নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীতেও ছিদ্র by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

রাজধানী ঢাকার অভিজাত পাড়া গুলশান কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত। সংগত কারণেই এলাকাটি একই সঙ্গে নিরাপদ এলাকা বলেও চিহ্নিত। অথচ এই গুলশান কূটনৈতিক জোনেই ৫ মার্চ ২০১২, রাতে খুন হলেন ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব খালাফ আল আলী।


এই মর্মন্তুদ ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন হলেও দেশের ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতির সাক্ষ্যই বহন করে, যা অবশ্যই চরম উদ্বেগজনক। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে বৈদেশিক মিশনের সদস্য খুন হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এমন এক সময়ে ঘটনাটি ঘটল, যখন দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ-সংক্রান্ত স্পর্শকাতর মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান। নানা মহল থেকে বারবার সতর্কবাণী উচ্চারিত হচ্ছিল, পরিস্থিতি ঘোলাটে করার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বানচালের জন্য নানা রকম অপপ্রয়াস চালানো হতে পারে। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছিলেন। এসবই আশংকার কথা। এই ঘটনার সঙ্গে এর যোগসূত্র আছে এমনটি বলছি না। তবে, নানারকম ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীলদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ফল যে কার্যত শূন্য এমন দৃষ্টান্তও প্রায় প্রতিনিয়তই মিলছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এত বায়বীয়, দায়সারা, অসতর্ক কথাবার্তা আর অদূরদর্শিতার ফল যে কত ভয়াবহ হতে পারে, ইতিমধ্যে সংঘটিত অনেক ঘটনা এরই সাক্ষ্যবহ। একটা বিষয় খুব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, একটা কিছু ঘটে যাওয়ার পর দায়িত্বশীলদের খানিক সময়ের জন্য টনক নড়ছে, পাশাপাশি তাঁদের কিছু অসংলগ্ন বক্তব্য পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। অন্যদিকে অপশক্তির ভয়ংকর সব কাণ্ডকীর্তি ক্রমেই বেগবান হচ্ছে।
বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এত যে কথা হচ্ছে, একের পর এক মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটছে তার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের যেন ঘোর কাটছে না। তাঁরা শুধু ষড়যন্ত্রই দেখেন এবং খোঁজেন; কিন্তু সিংহভাগ ক্ষেত্রেই ষড়যন্ত্রকারী, সমাজবিরোধী, অপহরণ কিংবা হত্যাকারীকে শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই ব্যর্থতার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। একদিকে গুপ্তহত্যা, অপহরণসহ নানা রকম দুষ্কর্ম ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, অন্যদিকে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর অতিকথন, দায়িত্বহীন মন্তব্য কিংবা তাঁদের অদূরদর্শিতার কারণে শুধু অপশক্তিই পরোক্ষভাবে আশকারা পাচ্ছে না, একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখার দায়দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদেরও কোনো না কোনোভাবে দায়মুক্তি ঘটছে। তাঁরা সরকারের দায়িত্বশীলদের নানা রকম অসংলগ্ন বক্তব্যের সুযোগে নিজেদের ব্যর্থতা চাপা দিয়ে উতরে যাওয়ারও সুযোগ পাচ্ছেন। একপর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট সমস্যাও এসব কারণেই রীতিমতো সংকটে রূপ নিচ্ছে এবং সরকারের কেউ কেউ যতই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলুন না কেন কিংবা দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, কার্যত অশুভর পাল্লাই ভারী হচ্ছে।
সৌদি আরব আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। আমাদের সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি দুই দেশের বিদ্যমান সম্পর্কের মধ্যে যাতে চিড় না ধরায়, সে জন্য এর যথাযথ কঠোর প্রতিকারের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত রাখা সরকারের গুরুদায়িত্ব। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রীতিকর। এ বিষয়টি আমলে রেখে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলদের মনে রাখতে হবে, তাঁরা যে বৃত্তে বরাবরই ঘুরপাক খাচ্ছেন, তা ভেঙে আস্থার বিষয়টি পুনরুদ্ধার করতে হবে। আমলে নিতে হবে এপির উদ্ধৃতি দিয়ে খালিজ টাইমসের প্রতিবেদনটি, যে প্রতিবেদনে এই হত্যা প্রসঙ্গ টানা হয়েছে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি। সম্প্রতি নানা কারণে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে এমনিতেই নানা রকম নেতিবাচক কথা উঠেছিল। নানা মাত্রিকতায় সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সৌদিতে কর্মরত বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর বিষয়টিও সমধিক গুরুত্ববহ। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ঢাকার কূটনৈতিক পল্লীর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি যাতে আন্তর্জাতিক মহলে ভিন্নভাবে স্থান না পায়, তা খেয়াল রাখার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বতো প্রয়াস জোরদার করা জরুরি। এই দুঃখজনক ঘটনার কঠোর প্রতিকারে বাংলাদেশ সরকার যা যা করার তা সবই করছে- এ বিষয়টিও কূটনৈতিক কোরের সদস্যদের আস্থায় আনতে হবে, একই সঙ্গে তাদের বোঝাতে হবে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায় অনেক বেশি। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থার অথবা সরকারের গাফিলতি, উদাসীনতা, কালক্ষেপণ কিংবা ব্যর্থতার নজির যেন এ ক্ষেত্রে সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারেও সর্বোচ্চ সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি। এনিতেই দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি ক্রমেই নিশ্চয়তা হারাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ অস্বাভাবিকভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন। এখন বিদেশি কূটনীতিকদের ক্ষেত্রেও যদি এমনটি ঘটতে থাকে, তাহলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরম ক্ষুণ্ন হবে। ৮ মার্চ ২০১২, গালফ নিউজের সম্পাদকীয় স্তম্ভে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্সিগুলোর সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ।' এদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে এবং ঘরের শত্রু বিভীষণরা নানাভাবে তৎপর আছেন। তাদের অপতৎপরতা ঠেকাতে সরকার ও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার চিত্রও খুব স্পষ্ট এবং এও পুরনো বিষয়।
রাজনৈতিক বিবেচনায় হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড মওকুফ ইত্যাদি ইতিমধ্যে বহুবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অপরাধপ্রবণ যে সমাজ প্রায় প্রতিক্ষণ থরথর করে কাঁপে, সে সমাজে এই দৃষ্টান্তগুলো সুখকর নয়। এর ফলে অপরাধীরাই আশকারা পায়। মনে রাখা দরকার, যেসব পারিপার্শ্বিকতা বিদ্যমান থাকার পরিপ্রেক্ষিতে একটা রাষ্ট্রকে অন্যরা অকার্যকর বলার অবকাশ পায়, সে সবের মধ্যে একের পর এক ঘটে চলা হত্যা, গুম, অপহরণ অন্যতম। অর্থাৎ জননিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সে রকম পরিস্থিতি যাতে দৃষ্টান্তের বিষয় না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করার দায় সরকারেরই। সৌদি নাগরিক তথা একজন দূতাবাস কর্মকর্তাকে হত্যা করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরাতে কিংবা অন্য কোনো কিছুর জন্য পানি ঘোলা করতে অশুভ শক্তি এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে, এমন মন্তব্য কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তবে ঘটনা যাই হোক, এর কঠোর প্রতিকারই একমাত্র প্রতিবিধান। কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা বেষ্টনী যে নিশ্ছিদ্র নয়, তাও এই ঘটনার পর নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। দায়িত্বশীল মহলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অতীতের ঘটনাগুলোর মতো তথ্য-প্রমাণবিহীন কোনো বক্তব্য দেওয়াও সংগত হবে না। সৌদি দূতাবাসের কূটনৈতিক কর্মকর্তা হত্যায় শুধু ঢাকা নয়, তামাম দুনিয়ায় প্রতিক্রিয়া হয়েছে। হত্যার নানা কারণ যুক্তি ও বিশ্লেষণ আসছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। যদিও সৌদি সরকার এখন পর্যন্ত অন্য রকম কোনো কথা বলেনি, কিন্তু বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ খালিদ বিন আহমদ আল খলিফা বলেছেন, 'হত্যাকারীরা চিহ্নিত।' সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক টুইটারে বাহরাইনের মন্ত্রী লিখেছেন, 'এটা প্রকাশ্যে যুদ্ধ আর হত্যাকারীরা পরিচিত।' অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের আঙুল উঠেছে ইরানের দিকে। হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নিয়োজিত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ঢাকায় অবস্থিত ইরান দূতাবাসকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন। দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে (সূত্র : সমকাল, ৮ মার্চ ২০১২)। তবে যাই হোক না কেন, খুনির অবস্থান এ সমাজেই- এটা তো নিশ্চিত। আকাশ থেকে পড়ে তো কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি। আর এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সব হত্যাকাণ্ড নিয়েই কথা বলছি। হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা না গেলে আইনের শাসন বলি আর ন্যায়নির্ভর সমাজ বলি, কিছুই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। মনে রাখা দরকার, এ বাংলাদেশেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী ও আত্মস্বীকৃত খুনিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছিল, দায়মুক্তি পেয়েছিল। কাজেই পতনের শুরুটা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওই রাষ্ট্রীয় অপকর্মের খেসারত আমাদের আর কত দিতে হবে? এ সমাজে, রাষ্ট্রে একদিন এই বোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, খুনেরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলে, পুরস্কার জোটে, দায়মুক্তি দেওয়া হয়। যে পচন ধরেছিল একদিন মাথায়, তা আজ সর্বাঙ্গে যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে। সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে পেছনের এই ঘটনাগুলো স্মরণ করতে হলো এ জন্য, অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা কিন্তু চূড়ান্ত সত্য পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম হয়েছেন। আইন সবার জন্য সমান, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন এবং দুষ্কর্মকারীরা কখনো রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের অনুকম্পা পেতে পারে না- এই বক্তব্য হলো ন্যায়ভিত্তিক সমাজের অঙ্গীকারও। কিন্তু এর উল্টো দৃষ্টান্তই এই জনপদে রয়েছে। আর যেন এমন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা না হয়।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.