ভারতের নগদ প্রাপ্তি, বাংলাদেশের ভাগে আশ্বাসঃ শেখ হাসিনার সফল সফর বটে!

চাণক্য কথিত ‘বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া’ সম্ভবত একেই বলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে উচ্ছ্বাস এবং কৌতূহলের কমতি ছিল না। বহুল আলোচিত চার দিনের সেই সরকারি সফর গতকাল শেষ হয়েছে। সফরকালে দু’দেশের শীর্ষ নেতারা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। প্রকাশিত হয়েছে যুক্ত ইশতেহার।
স্বাক্ষরিত হয়েছে তিনটি চুক্তি এবং দুটি সমঝোতা স্মারক। কিন্তু মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে শেখ হাসিনা এবং মনমোহন সিং অনেক সুন্দর কথা বললেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরকে কোনো যুক্তিতেই ঐতিহাসিক, নবদিগন্তের সূচনাকারী ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা যাচ্ছে না। যুক্ত বিবৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উদার বাংলাদেশ সরকার ভারতকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি ভারত থেকে আদায় করতে পেরেছে একগাদা আশ্বাস। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। এটা একটা আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এতে তার সম্মান বেড়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বস্তুগত লাভের ভাড়ারে কিছুই জমা পড়েনি। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আবেগাপ্লুত হয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে একজন জঙ্গিবিরোধী ক্রুসেডর বলে উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগের খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাদের ক্রুসেডর বলা হতো। ক্রুসেডররা দীর্ঘদিন মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তাই একজন মুসলমানকে ক্রুসেডর আখ্যা দিলে তাতে তার সম্মান বাড়ে না কমে—এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। আগেরবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারত সফরের সময় শেখ হাসিনা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তার সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকে বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী সম্বোধন করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী থেকে ক্রুসেডর—আমরা কিন্তু দিনবদল অথবা মানসিকতা বদলের কোনো লক্ষণ দেখছি না। ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীরা একত্রে নাচ-গান করবেন—এটা কী করে দু’দেশের শীর্ষ বৈঠকের এজেন্ডায় আসতে পারে এবং যুক্ত ইশতেহারে স্থান পাবার মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে, তা আমাদের মাথায় ঢুকছে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে ভারতকে যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—ভারত আশুগঞ্জ দিয়ে ত্রিপুরায় ট্রানজিট সুবিধা পাবে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে, আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ পাচ্ছে নতুন কিছু পণ্যের ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা এবং ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির সুযোগ। বাংলাদেশের তরফ থেকে দুটি বার্নিং ইস্যু ছিল তিস্তাসহ অভিন্ন নদীসমূহের পানির ন্যায্য হিস্যা এবং প্রস্তাবিত টিপাইমুখ ড্যাম। তিস্তার কোনো উল্লেখ বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারে নেই। টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে, কথার মারপ্যাঁচ ভেদ করে তার মর্মার্থ উদ্ধার করা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, বরং অসাধ্য।
ভারত যেসব সুবিধা পেয়ে গেল সেগুলো ভারতকে এবার দেয়া হবে, তেমন আশঙ্কা দেশের মধ্যে আগেই গুঞ্জরিত হচ্ছিল। বিনিময়ে বাংলাদেশ যা পেল তার মাজেজা যে কী, ইতোমধ্যে যেসব বাংলাদেশী পণ্য ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পেয়েছে, তার ফল পর্যালোচনা করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ভারত ১০০ কোটি ডলারের যে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে, তা দিয়ে ভারত থেকেই পণ্য ও সার্ভিস কিনতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত বললেও কম বলা হয়। ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির সম্ভাবনা এখনও অনেক ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’র ওপর নির্ভরশীল। তাই, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ‘নাকের বদল নরুন পেলাম’ বলার মতোও নয়। তবুও আওয়ামী লীগ সম্ভবত মুখ রক্ষার জন্য ‘তাক ডুমাডুম ডুম’ গেয়েই চলেছে।

No comments

Powered by Blogger.