স্মরণ-মৃত্যুঞ্জয়ী নুরুল ইসলাম ফয়েজ by মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ

'ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উন্নতি সাধনে প্রকৃত সুখ নেই। কেননা এর আবেদন ক্ষণস্থায়ী। সামাজিক উন্নয়ন তথা অসহায় ও দরিদ্রদের কল্যাণে কাজ করার মধ্যেই প্রকৃত সুখ। এ সুখের ব্যাপ্তি অনন্ত।' এ জীবনদর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন নুরুল ইসলাম ফয়েজ।


ব্যক্তি ও পারিবারিক বিষয়ে অনেকটা উদাসীন এ মানুষটি ছিলেন তাঁর জন্মস্থান মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী জনপদ জুড়ী উপজেলার আপামর জনতার অতি আপনজন। নিজ দলের বড় কোনো নেতা কিংবা জনপ্রতিনিধি না হয়েও তিনি ছিলেন তাঁর এলাকার দরিদ্র, অসহায়দের সহায় ও আশ্রয়স্থল, বিপন্ন মানুষের ভরসার পাত্র। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পরিচালনা পর্ষদের নেতাদের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এলাকার বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয় যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় বিদ্যালয়ের ফলাফল যখন ক্রমেই নিম্নগামী, প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষকরা যখন ক্রমান্বয়ে বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এমতাবস্থায় স্কুলকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন ২২ বছরের তরুণ নুরুল ইসলাম ফয়েজ। সমবয়সী অন্যরা যখন দেশ-বিদেশে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ায় ব্যস্ত, তুখোড় মেধার অধিকারী হয়েও নিজের ভবিষ্যৎ নয়, তিনি তখন এগিয়ে এলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় বিদ্যালয়কে রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত করতে। সেদিনকার তাঁর এই সাহসী পদক্ষেপ কেবল একটি স্কুলকেই রক্ষা করেনি, নতুন করে আশার প্রাণ সঞ্চার করেছিল পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। একদা অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়া স্কুলটি আজ জেলার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফলাফল করছে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ২০১১ সালে জেএসসি পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডের শীর্ষ ১০ বিদ্যালয়ের ছোট্ট তালিকায় স্থান করে নিয়েছে জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয়। ইতিমধ্যে স্কুলটিকে মডেল হাই স্কুল ঘোষণা করা হয়েছে। পরে পর্যায়ক্রমে স্থানীয় তৈয়বুন্নেচ্ছা খানম ডিগ্রি কলেজ, এলাকার একমাত্র নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মক্তদীর গার্লস হাই স্কুলসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে একাকার করে নিয়েছিলেন। শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া সমাজ উন্নয়ন সম্ভব নয় জেনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক চিন্তাচেতনাকে পাশ কাটিয়ে এলাকার শিক্ষার প্রসারেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন, নিজ এলাকাকে উপজেলায় রূপান্তর, খেলার মাঠ স্থাপন, সাহিত্য চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ স্থাপন, সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠাসহ সব সামাজিক কর্মকাণ্ডের অগ্রভাগে ছিল তাঁর অবস্থান। কবি কামিনী রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী পরের কারণে নিজের জীবন-মন বিলিয়ে দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আমজনতার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সকাল, দুপুর কিংবা মধ্যরাত যখন বিপদের সম্মুখীন হয়ে কেউ সহায়তা চেয়েছেন, শত বাধাবিপত্তি পেছনে ফেলে ছুটে চলেছেন সেই বিপদগ্রস্তের পাশে আশার প্রতীক হয়ে। অসহায়, বিপদগ্রস্তের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর মূল ব্রত। তাঁর কাছে এসে সান্ত্বনা না পেয়ে কেউ ফিরে গেছে, এমন নজির নেই। ২০১০ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ করেই মরণব্যাধি ক্যান্সার আঘাত হানল এই পরহিতকারী মানুষটির দেহে। দেশ-বিদেশের সর্বাধুনিক চিকিৎসায়ও হার মানল না ঘাতক ক্যান্সার। ৮ মার্চ ২০১১ তারিখে চূড়ান্ত বিজয়ের মালা পরাল ঘাতক ক্যান্সার। মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই পৃথিবী ছাড়লেন নিজ জন্মস্থানের সামাজিক সম্পদে পরিণত হওয়া সদাকল্যাণকামী এ মানুষটি। মৃত্যুর মাধ্যমে নিজেকে বিজয়ী করেছেন নুরুল ইসলাম ফয়েজ। মৃত্যুতেও বিজয়ী তিনি।
মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ

No comments

Powered by Blogger.