বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৩৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোশাররফ হোসেন, বীর প্রতীক কুশলী এক মুক্তিসেনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের বেলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে যান মোশাররফ হোসেন। তাঁর বেশভূষা দেখে সেনারা সন্দেহ করে না।


গোপনে তিনি পর্যবেক্ষণ (রেকি) করেন পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। তারপর ফিরে যান নিজেদের শিবিরে। শিবিরে বসে তৈরি করেন মানচিত্র। দূরত্ব হিসাব করে তা বুঝিয়ে দেন দলনেতার কাছে। দুই-তিন দিন পর নির্ধারিত হয় আক্রমণের সময়। তখন আবার চলে যান পাকিস্তানি অবস্থানের কাছে। এবার অবস্থান নেন উঁচু গাছে। নির্ধারিত সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে শুরু হয় গোলাবর্ষণ। গাছের ওপর বসে মোশাররফ হোসেন লক্ষ করেন সেগুলো সঠিক নিশানায় পড়ছে কি না। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দলের কাছে নির্দেশনা দেন। তাঁর নির্দেশনায় নিখুঁত নিশানায় গোলা পড়তে থাকে। দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের।
মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত আক্রমণে ফায়ারিং সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর দুটি গোলন্দাজ দল। দুটি ফিল্ড ব্যাটারির একটির নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এর নাম ছিল ‘মুজিব ব্যাটারি’। অন্যটির নাম ছিল ‘রওশন আরা ব্যাটারি’। মুজিব ব্যাটারি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘কে’ ফোর্সের অধীনে ছিল। তাদের কাছে ছিল ফিল্ড আর্টিলারি।
মোশাররফ হোসেন ছিলেন মুক্তিবাহিনীর গোলন্দাজ দলের সদস্য। মুজিব ব্যাটারির ওপি হিসেবে তিনি শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পর্যবেক্ষণ (রেকি) করতেন। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আক্রমণ পরিচালিত হতো। সফলতার সঙ্গে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
মোশাররফ হোসেন ১৯৭১ সালে কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুজাহিদ বাহিনীর (১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত অনিয়মিত বাহিনী। তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো) প্রশিক্ষণও তাঁর নেওয়া ছিল। ২৫ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসিক এলাকায় ছিলেন। পরে ঢাকা থেকে পালিয়ে নিজ এলাকায় যান। সেখানে এলাকার ছাত্র-যুবক সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। কিছুদিন পর ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ২ নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাব-সেক্টরে দুই-তিনটি গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। পরে তাঁকে মুক্তিবাহিনীর গোলন্দাজ দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোশাররফ হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৬০। গেজেটে নাম মোশাররফ হোসেন বাঙাল।
মোশাররফ হোসেন ১৯৮৯ সালে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৭ বছর। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার ভীমপুর গ্রামে। বাবার নাম মোবারক উল্লাহ। মা আম্বিয়া খাতুন। স্ত্রী জাহেদা খাতুন। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। স্ত্রী জাহেদা খাতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে বর্তমানে ঢাকায় (১২৮/৪ সুলতানগঞ্জ, রায়েরবাজার) তাঁর বাবার বাড়িতে বসবাস করেন।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেড-ভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.