এশিয়া কাপের কাছে ঋণ by উৎপল শুভ্র

এশিয়া কাপের অনেক রং। তার মধ্যে উজ্জ্বলতম রংটি কি মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশে? ক্রিকেটে মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট এই একটাই এবং অদূর ভবিষ্যতে এটির একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে থাকাটাও নিশ্চিতই বলতে পারেন। আর কোনো মহাদেশে তো দুটির বেশি টেস্ট খেলুড়ে দেশই নেই, মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট হবে কীভাবে?


এশিয়ার এই ক্ষমতাটা সবচেয়ে ভালোভাবে, সবচেয়ে আগে বুঝেছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। বাকি ক্রিকেট বিশ্বকেও তা বোঝাতেই কিনা, এশিয়া কাপের ধারণাটা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। যেটির বীজ বোনা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরের বছর মরুরাজ্য শারজায় এশিয়া কাপ শুরুর পথটাও ডালমিয়ারই এঁকে দেওয়া।
ভারতের কী একটা ওয়েবসাইটে দেখলাম, ডালমিয়ার রাজত্বকালের সঙ্গে এশিয়া কাপে ভারতের সাফল্যের যোগসূত্র টানা হয়েছে। প্রথম পাঁচটি এশিয়া কাপের যে চারটিতে অংশ নিয়েছে ভারত, সে চারটিতেই তারা শিরোপার আলোয় উজ্জ্বল। ডালমিয়া ক্ষমতা হারানোর পরই নাকি ভারতের দিনও শেষ! পরের চারটি টুর্নামেন্টেই ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতার ধারায় ছেদ টেনে ভারত আবার জিতেছে এশিয়া কাপ। যেটি সম্ভবত এই উপমহাদেশে এশিয়া কাপের সবচেয়ে কম আলোচিত আসর। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কায় সেই টুর্নামেন্টটি যে প্রায় অদৃশ্য হয়ে ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের বর্ণচ্ছটায়।
২.
টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত ভুবনে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার পাওয়ায় জগমোহন ডালমিয়ার বিশ্বায়ন মন্ত্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। পরোক্ষ ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ১৪ বছর আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেকেও। টেস্ট পরিবারের বাইরের দেশগুলোর এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার একমাত্র সুযোগ তখন বিশ্বকাপ। অথচ বাংলাদেশ তা দিব্যি খেলে ফেলল এই এশিয়া কাপের কল্যাণেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট-ইতিহাসে এশিয়া কাপের তাই আলাদা একটি জায়গা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে টেস্ট-পূর্ব বাংলাদেশের বিনি সুতোর মালা হয়ে ছিল এই টুর্নামেন্টটিই। শারজায় ১৯৯০ সালের অস্ট্রেলেশিয়া কাপ একমাত্র ব্যতিক্রম, নইলে আন্তর্জাতিক সুবাস গায়ে মাখতে বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা চাতকের মতো তাকিয়ে থাকতেন এই এশিয়া কাপের দিকে। ১৯৯০ সালের পর যে এশিয়া কাপে দুই বছরের বদলে পাঁচ বছরের বিরতি পড়ল, তা নিয়ে বাংলাদেশই তাই আক্ষেপ করেছে বেশি।
৩.
এশিয়া কাপকে প্রথম পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার কৃতিত্বটাও বাংলাদেশেরই। ১৯৮৪ সালে শারজায় প্রথম আসরে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা তিন দেশই ছিল। ১৯৮৬ শ্রীলঙ্কা এশিয়া কাপে ভারত যায়নি (বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতেও কি ভূমিকা ছিল এর? দুই দল নিয়ে তো আর টুর্নামেন্ট হয় না)। ১৯৯০ সালে ভারতে যায়নি পাকিস্তান। মাঝখানে, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে আয়োজিত তৃতীয় এশিয়া কাপেই প্রথম চার দল।
বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। যেটি আক্রান্ত করছে স্মৃতিকাতরতায়। আমার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পাওয়াও তো সেটিই প্রথম। তবে সাংবাদিক নয়, সেটি নিখাদ দর্শকের ভূমিকায়। সত্যি কথাটা বলেই ফেলি, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে তখন বলতে গেলে আমার তেমন আগ্রহই ছিল না। বাংলাদেশ খেলছে, খুব ভালো। কিন্তু আসল আকর্ষণ তো বাকি তিন দেশের তারকারা। আসলে দুই দেশ। শ্রীলঙ্কানরা তখনো এমন কোনো তারকা হয়ে ওঠেনি।
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে ভোর ছয়টা থেকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। দর্শকে পূর্ণ স্টেডিয়াম বোঝাতে ‘তিল ধারণের ঠাঁই নেই’ বলে যে কথাটা বলা হয়, সেটি বাস্তবে দেখেছিলাম সেদিন। পরে বঙ্গবন্ধুর নাম ধারণ করা সে সময়ের ঢাকা স্টেডিয়ামের কংক্রিটের আসন আর ফেন্সিংয়ের সঙ্গে যে ফাঁকা জায়গাটা, সেখানে পর্যন্ত গায়ে-গায়ে লাগানো দর্শক। যারা সামনে, ফেন্সিংয়ে চাপ খেয়ে তাদের চিড়েচেপটা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!
সকাল-সকাল এসেছিলাম বলে ওপরে নিরাপদে বসেই তা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই ম্যাচে আরশাদ আয়ুবের বোলিং আর মহিন্দর অমরনাথের ব্যাটিংয়ে জিতল ভারত। ফাইনালে আর দুই দলের দেখা হলো না বলে সেটির আকর্ষণই যেন কমে গেল অর্ধেক। এত দিন পর সেই এশিয়া কাপের দিকে তাকিয়ে কেন যেন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে রোশান মহানামার কথা। পয়েন্টে ক্ষিপ্র চিতার মতো মহানামার মাধ্যমেই যে বিশ্বমানের ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
৪.
১৯৮৮ এশিয়া কাপের বাড়তি একটা উপহারও ছিল। সেই টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত দেশ। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে একটা চ্যারিটি ম্যাচ হয়েছিল। চ্যাম্পিয়ন ভারতের সঙ্গে খেলেছিল আমন্ত্রণমূলক একাদশ। প্রথম ও শেষবারের মতো সুনীল গাভাস্কারের ব্যাটিং চাক্ষুষ দেখার সুযোগও করে দিয়েছিল ওই ম্যাচ। খেলেছিলেন উপমহাদেশের আরেক ব্যাটিং কিংবদন্তি জহির আব্বাসও। ফ্লপি হ্যাট পরা গাভাস্কারের ব্যাটিংয়ের ছবি চোখে ভাসছে, জহির আব্বাসের কবজির মোচড়ও—কিন্তু খটকা জাগাচ্ছে ওই ম্যাচের সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকা স্মৃতিটা। পাকিস্তানি লেগ স্পিনার আবদুল কাদির বল করলেন, গাভাস্কার ব্যাট চালাতেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল বল! ক্রিকেট বলের পরিবর্তে আপেল দিয়ে বোলিং করেছেন কাদির—এটি আবিষ্কৃত হতেই তুমুল হর্ষধ্বনি। কিন্তু খটকাটা কোথায়? কাদির নিশ্চয়ই আমন্ত্রণমূলক একাদশের হয়েই খেলেছিলেন। গাভাস্কারেরও তা-ই খেলার কথা। তাহলে গাভাস্কারকে বল করলেন কীভাবে? গাভাস্কার কি তবে ছিলেন ভারতীয় দলে? ঠিক মনে করতে পারছি না।
তবে এটা মনে করতে পারছি, গাভাস্কারকে স্টাম্পিং করার পর উইকেটকিপারের বিব্রতকর ভঙ্গি। দর্শকেরা যে তাঁকে দুয়ো দিচ্ছেন! গাভাস্কারের ব্যাটিং দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করায় সেটিই তো তাঁর প্রাপ্য!
৫.
এবারও কি পুনরাবৃত্তি হবে এমন কিছুর—শচীন টেন্ডুলকার আউট হয়ে গেলে মন খারাপ হয়ে যাবে প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদেরও? গ্যালারির দর্শকদের বোধ হয় হবেই। গত কিছুদিন টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ের সময় আবহসংগীত হয়ে বেজে যাচ্ছে বিদায়ের রাগিণী। বাংলাদেশের দর্শকদের টেন্ডুলকারের ব্যাটিং চাক্ষুষ দেখার শেষ সুযোগ তো এটাই। বাকি জীবনের জন্য গল্পের রসদ সঞ্চয়েরও।
ক্রিকেটের প্রেসবক্সে এখন বিলুপ্তপ্রায় একটা প্রজাতিকে ঘিরে একসময় সহ-সাংবাদিকদের ভিড় জমে থাকত। ওঁরা যে ডন ব্র্যাডম্যানকে ব্যাটিং করতে দেখেছেন! আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর পর মাঠে বসে শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখার গল্প শোনার চাহিদাও তো এমনই হওয়ার কথা।
শচীন টেন্ডুলকারকে শেষবারের মতো দেখে নিন। নাতি-নাতনির কাছে গল্প করতে পারবেন।

No comments

Powered by Blogger.