আমরা কিছুই শিখছি না by কাজী জহিরুল ইসলাম

প্লেন থেকে নেমেই মেজাজটা বিগড়ে গেল। লন্ডন থেকে দুবাই, দুবাই থেকে আক্রা হয়ে আবিদজান। ১৭ ঘণ্টা উড়াল সময়, দুবাইয়ে চার আর আক্রায় এক ঘণ্টা ট্রানজিট, মোট ২২ ঘণ্টার টানা ভ্রমণ শেষ করে কারোরই মেজাজ ফুরফুরে থাকার কথা নয়। তার ওপর আক্রায় বসে বসের ফোন, প্লেন থেকে নেমেই যেন সরাসরি অফিসে চলে আসি, নিউইয়র্কের সঙ্গে একটি অডিও-ভিডিও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে হবে।

ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, না ছেলেটাকে কোথাও দেখছি না। ও কি তাহলে আসেনি? ফোন তুলে কল করতে যাব তখনই থালার মতো কালো মুখমণ্ডলে দু’পাটি ঝকঝকে দাঁতে ঝিলিক দেখতে পেলাম। ‘শুভ প্রত্যাগমন, জনাব’। মুখে ধন্যবাদ বললেও মনে মনে ওকে বেশ কয়েকটা গালি দিতে ছাড়লাম না। টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে দ্বিতীয় দফায় মেজাজ খারাপ হলো। গাড়ি কোথায়? ও হাত তুলে দেখাল, ওই তো। এইমে কোয়াদিও, আমার স্থানীয় সহকর্মী, টার্মিনাল ভবনের গা-ঘেঁষে অবৈধভাবে গাড়ি পার্ক করেছে। ওর নজরে তেমন কিছুই পড়ল না, কিন্তু আমি দূর থেকেই দেখতে পেলাম গাড়ির চাকায় ক্লাম্প লাগানো। দু’জনই ছুটে গেলাম। আমি রীতিমত গজরাতে শুরু করেছি। এইমে বললো অসুবিধা নেই, দুই হাজার সিএফএ (বাংলাদেশী টাকায় ২৫০ টাকা) দিলেই খুলে দেবে।
কিন্তু আইভরিয়ান পুলিশ কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। এ কী আশ্চর্য কাণ্ড, আইভরিয়ান পুলিশ ঘুষ নিচ্ছে না! এইমে অনেক চেষ্টা করে ফিরে এলো। বস, ও কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। আমাদের পুলিশ বক্সে গিয়ে ১০ হাজার সিএফএ ফাইন দিতে হবে। কথাটা বলেই ও মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছি এ বেকুবটার বোকামির খেসারত আমাকেই দিতে হবে। পকেট থেকে ১০ হাজার সিএফএ বের করে ওর হাতে তুলে দিলাম। পাঁচ মিনিটে ক্লাম্প খুলে গেল। এইমে আমার হাতে একটি ১০ হাজার সিএফএ’র মানি রিসিট ধরিয়ে দিল। এ ঘটনাটি আমি কেন উল্লেখ করলাম? আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে যখন আইভরিকোসেল্ট আসি তখন দেখেছি আইভরিয়ান পুলিশগুলো ঘুষ খাওয়ার জন্য পারে তো মানুষের ঘাড়ে ধরে। আমার এক সহকর্মী জ্যাঁ-মারি ত্রা ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিতে রাজি না হয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়। আর কি, পেছন থেকে গুলি ছোড়ে পুলিশ, সেই গুলি এসে ওর পাশের আসন ফুটো করে দেয়। মাত্র দু’বছর আগের কথা। বাংলাদেশের বর্তমান আইজিপি নূর মোহাম্মদও ২০০৭-এ একবার আইভরিকোসল্ট ভিজিট করতে আসেন। আমার গাড়িতে করেই তাকে রাতের আবিদজান শহর ঘুরে দেখাই। তখন তাকেও দেখিয়েছিলাম, বিভিন্ন স্থানে গাড়ি থামিয়ে কীভাবে আইভরিয়ান পুলিশ ঘুষ নেয়। সেই পুলিশ এত সভ্য হয়ে গেল? বিষয় কী? বিষয় হলো, আইভরিয়ানরা তাদের হৃতগৌরব ফিরে পেতে চাচ্ছে। আর নয় অনিয়ম-দুর্নীতি, আর নয় মারামারি। আইভরিকোসেল্টর জাতির পিতা, ৩৩ বছরের প্রেসিডেন্ট ফেলি উফুয়ে বৈগনির শাসনামলে যে সোনার দেশ ছিল, ওরা আবার সেই সোনার দেশ ফিরে পেতে চায়। তার শাসনামলে আইভরিকোসল্ট ছিল পশ্চিম আফিদ্ধকার সুপার পাওয়ার। সেই সময় আবিদজান শহরে পা রেখেই মানুষ বুঝতে পারত এ শহর সোনায় মোড়ানো। এর কিছুটা রেশ এখনও রয়েছে এর অবকাঠামোগুলোয়। বিমানের রানওয়ের মতো সুপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, অসংখ্য ফ্লাইওভার, ট্রাফিক আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ, ভ্যাটিকানের চেয়েও বড় স্থাপত্যশিল্প বাসিলিকা নির্মাণ, ইউরোপীয় মানের অসংখ্য সুপার মার্কেট, বার-রেস্তোরাঁ—এ সবই মনে করিয়ে দেয় একদিন ওরা সত্যিই আফিদ্ধকার হাতি ছিল। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৈগনি আন্তর্জাতিকভাবেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। সুদূর উত্তর আফিদ্ধকার গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর কাসাব্লাঙ্কা, যেখান থেকে মাত্র একটা লাফ দিলেই স্পেন, হাত বাড়ালেই ব্রিটিশ জিব্রালটার, সেই আধুনিক শহরের প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট ফেলি উফুয়ে বৈগনি এভিনিউ’। কাসাব্লাঙ্কার মাঝবয়েসী প্রতিটি মানুষ এখনও বৈগনির নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন। অফিসে ফিরতে ফিরতে এইমের সঙ্গে হঠাত্ আইভরিয়ান পুলিশের এই অতি সভ্য আচরণ নিয়ে অনেক কথা হয়। আমরা যখন নীল লেগুনটা পার হচ্ছিলাম তখন এইমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—এটাই প্রকৃত আইভরিয়ান পুলিশের আচরণ, আপনি এতদিন যা দেখেছেন তা নষ্ট হয়ে যাওয়া আইভরিয়ান সমাজের চিত্র।
২৯ নভেম্বর নির্বাচন হওয়ার কথা আইভরিকোসেল্ট। সম্ভবত এই তারিখটি ওরা ঠিক রাখতে পারবে না। কিন্তু খুব শিগগিরই নির্বাচন হবে এখানে। আর এর পরই বদলে যাবে আইভরিকোসল্ট। প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা আইভরিয়ানদের আবার এনে দাঁড় করাবে সভ্যতার প্রশস্ত এভিনিউতে, যে এভিনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা একদিন পৌঁছে যাবে উন্নত দেশের কাতারে। পৃথিবীর অনেক দেশই এমনই করে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে পৃথিবীর অনেক দেশের মানবিক, অর্থনৈতিক সূচক আমাদের নিচে ছিল। তারা সবাই বুঝতে পেরেছে দেশ থেকে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি দূর করতে না পারলে, রাজনীতিতে সৎ নেতৃত্বের আগমন না ঘটলে জাতি হিসেবে কিছুতেই এগুনো যাবে না। কেবল আমরাই বুঝছি না। তাই সবাই যখন উন্নয়নের প্রশস্ত এভিনিউতে দৌড়াচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে, আমরা তখনও প্রিমেটিভ যুগের মতো নিজের, পরিবারের ও গোত্রের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি করছি, আর তাকিয়ে দেখছি অন্যরা কীভাবে আমাদের পাশ কেটে সামনে চলে যাচ্ছে।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.