কলাপাড়ায় ৩ লক্ষাধিক মানুষের দুর্যোগকালে নিরাপদ আশ্রয় নেই by নুরুজ্জামান মামুন

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় কলাপাড়ায় প্রতি বছরই গোর্কি, সিডর, আইলার মতো দানবীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্যোগকালে উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নের ৩ লাখ মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নেয়া হচ্ছে না প্রয়োজনীয়সংখ্যক সাইক্লোন শেলটার নির্মাণের উদ্যোগ। তিন যুগ আগে নির্মিত সাইক্লোন শেলটারগুলো ঘোষণা করা হয়েছে পরিত্যক্ত। এসব পরিত্যক্ত সাইক্লোন শেলটারের ভবনগুলো বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করায় যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।


বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের মহাপ্লাবনে পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে কলাপাড়ায় ৪ হাজার ৬০৯ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর পর বন্যার হাত থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় বিশ্বব্যাংক ৩১টি ও পরবর্তী সময়ে বেসরকারি সংস্থা কারিতাস ৩৭টি এবং রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ৫টিসহ মোট ৮৪টি সাইক্লোন শেলটার নির্মাণ করে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এগুলোর বেশিরভাগ অনেক আগেই ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে পড়ে। স্থানীয় সরকার অধিদফতর বেশ কয়েক বছর আগে ১৭টি সাইক্লোন শেলটার পরিত্যক্ত ও বাকি ১৪টির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ঘোষণা করেছে। বর্তমানে বাকি ৫৩টির অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার লতাচাপলী, মিঠাগঞ্জ, খাপড়াভাঙ্গা ও নীলগঞ্জ ইউনিয়নের জরাজীর্ণ সাইক্লোন শেল্টারগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা করার পর এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিরুপায় হয়ে প্রতি মুহূর্তে
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিত্যক্ত সাইক্লোন শেলটারের ভবনগুলো বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব ভবন ভেঙে যে কোনো সময়ে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডর-পরবর্তী চার বছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে ৩১টি সাইক্লোন শেলটার টাইপ স্কুল নির্মাণ করে। বিদেশি দাতা সংস্থা জাইকা ২টি, বেসরকারি সংস্থা কারিতাস ৮টি, ‘গিশব’ ৪টি এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থ সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ১১টি বড় আকারের সাইক্লোন শেলটার নির্মাণ করে। এছাড়া জাইকা ২টি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১টি মসজিদ কাম সাইক্লোন শেলটার নির্মাণ করে। প্রতিটি সাইক্লোন শেলটারে দুর্যোগকালে ৮শ’ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের অধীনে আরও ৪টির নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। নির্মাণকৃত সাইক্লোন শেলটারগুলোর একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার। ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরের সময় এ উপজেলায় মারা যায় ১০৪ জন। এসব মানুষের অধিকাংশেরই বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস ছিল। তবে মারা যাওয়া লোকজনের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু ও বৃদ্ধা। আবহাওয়ার বিপদ সঙ্কেত পেয়ে অধিক দূরত্বে অবস্থিত সাইক্লোন শেলটারে আশ্রয় নিতে যাওয়ার পথে বানের স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
উপজেলা পরিসংখ্যান কার্যালয় এখনও ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য প্রকাশ না করলেও ২০০১ সালের আদমশুমারির হিসাব অনুযায়ী কলাপাড়া উপজেলায় লোকসংখ্যা রয়েছে ২ লাখ ৭৮ জন, যা বর্তমানে চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা। উপজেলার আয়তন, জনসংখ্যা এবং বর্তমানে ব্যবহার উপযোগী সাইক্লোন শেলটারগুলোর অবস্থান দুর্যোগকালে মানুষের আশ্রয়ের জন্য সংখ্যার দিক দিয়ে একেবারেই অপ্রতুল। উপজেলার বর্তমান জনসংখ্যা অনুযায়ী কমপক্ষে দুইশ’ সাইক্লোন শেলটার নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর। অন্যথায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে থাকতে হবে দুর্যোগকালীন মৃত্যু ঝুঁকিতে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলে প্রতিবছরই গোর্কি, সিডর, আইলার মতো দানবীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নে কখনোই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেলটার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কলাপাড়া উপজেলা রেডক্রিসেন্ট সভাপতি মো. মহিউদ্দিন উদ্দিন বলেন, বর্তমানে সাইক্লোন শেলটার ও সরকারি-বেসরকারি দফতর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ উপজেলায় অন্যান্য যে স্থাপনা রয়েছে তাতে বড়জোর ৮০ থেকে ৯০ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারে। বাকি তিন লক্ষাধিক মানুষ দুর্যোগকালে নিরাপদ আশ্রয়ের বাইরে থেকে যায়। এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি উপ-সহকারী পরিচালক মুন্সী নুর মোহাম্মদ জানান, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মানুষের জন্য দুর্যোগকালে প্রতিটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টি করে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য মাটির কিল্লারও সংস্কার করা দরকার এবং নতুন করে মাটির কিল্লা নির্মাণ করা হলে দুর্যোগকালে জীবনের ঝুঁকি কমে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.