টাচ লাইন থেকে -মোস্তফা মামুন-সংগঠকনামা

ডানা বনাম কিরন লড়াইটা দারুণ জমজমাট। একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে কিছু। কেউ বলছেন কিরনের নির্বাচিত কমিটি ভাঙাটা কোনো কাজের কথা নয়, আবার অন্য পক্ষের কাছে এটাও যুক্তি যে খেলোয়াড়ি পটভূমিকাবিহীন কিরনের তুলনায় জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো ডানা অনেক এগিয়ে। এ নিয়ে বিতর্ক-নাটক। নাটকের আরো কিছু অধ্যায় সম্ভবত আগামী কিছুদিন অভিনীত হবে। এ নাটক নিয়ে ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে খেয়াল করছি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে কর্তা-সংগঠকরা সব হঠাৎ করে গোলমালের নায়ক হয়ে উঠেছেন।


এমনিতেও তাঁদের অনেকেই বিতর্কিত, বেশির ভাগের কর্মক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ; খেলার উন্নতির চেয়ে নিজেদের উন্নতি নিয়ে তাঁরা বেশি ভাবেন বলে প্রচারিত এবং সাংগঠনিক যোগ্যতার চেয়ে ধরাধরি বা সোজা ভাষায় লাইনবাজির দিকেই তাঁদের মূল মনোযোগ এবং এই করে করে চলেও তো যাচ্ছে। নইলে দাবার মোকাদ্দেস নামের একজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে খেলোয়াড়রা খেলা বর্জন করার পরও তিনি টিকে থাকেন কী করে! হকি খেলা হয় না কিন্তু কমিটি বছরের পর বছর দিব্যি চলে। আরো কত কত কর্মকর্তা ২০-২৫ বছর ধরে কী এক চুম্বকের জোরে চেয়ারটাকে স্থায়ী করে নিয়েছেন। তা খেলা স্বর্গে যাক আর গোল্লায় যাক।
আমাদের জীবন থেকে বহু জিনিস হারিয়ে গেছে। প্রযুক্তি-আধুনিকতা-সময়ের স্রোত এসব বেগ দিয়ে কেড়ে নিয়েছে আবেগ; বলেন অনেকেই। কথাটা সামগ্রিক অর্থে ঠিক না বেঠিক কে জানে কিন্তু সমাজে যেন এর কুফলের ছবি দেখা যায়। এখন আর আদর্শবান শিক্ষকের দেখা মেলে না, যিনি মেধাবী কিন্তু গরিব ছাত্রের পরীক্ষার ফিস নিজের পকেট থেকে দিয়ে দেন। এমন রাজনীতিক এখন আর নেই যিনি মানুষকে ভালোবেসে নির্বাচনে জিততে চান এবং এমন সংগঠক বা কোচও দেখা যায় না যাঁরা জীবন-সংসার-উন্নতি সব কিছুর মায়া ভুলে পড়ে থাকেন খেলা নিয়ে। কী পেলাম হিসাব করেন না, কী দিলাম শুধু তা-ই ভাবেন। এখন খেলা নিয়ে তাঁরাই থাকেন যাঁরা দেখেন এখানে আয় আছে, উন্নতি আছে, ক্যারিয়ার আছে। ক্রিকেট বোর্ডের সদস্য হয়ে গেলে সমাজে স্ট্যাটাস বাড়ে বলে ক্রিকেটের পেছনে সবচেয়ে বড় লাইন। নগদ নারায়ণের সুযোগ আছে বলে অনেকে যোগ হয়ে যান কোনো না কোনো ক্লাবের সঙ্গে। ছোট ফেডারেশনগুলোতে কী এমন লাভ! সেই হিসাব অনেকের কাছে অস্পষ্ট। কিন্তু এই পরিচয়ের ভূমিকা সাধারণ্যে থাকুক না থাকুক, ক্রীড়াঙ্গনে-ক্রীড়া পরিষদে-মন্ত্রণালয়ে এর জোর আছে। অনুদান-টেন্ডার-বিদেশযাত্রা এসব 'লক্ষ্মী'র ডাক শোনা যায় ওখানেও। কাজেই ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে তথাকথিত সংগঠকদের কমতি নেই। হানাহানি-লবিং-দলবাজি চলে। আর বাংলাদেশে আর দশ জায়গায় যেমন তেমনি এখানেও লাইনবাজ-দলবাজদের জয়জয়কার।
দিন কয়েক আগের কথা। জাতীয় দলের সাবেক এক অধিনায়ক ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, তিনি মাঠে বাংলাদেশের খেলা দেখতে যাচ্ছেন না।
কেন? সৌজন্য টিকিট পাচ্ছেন না!
টিকিট পাচ্ছি কিন্তু পার্কিং পাচ্ছি না। নিজে ড্রাইভ করি, কাজেই পার্কিং না পেলে গাড়ি রাখব কোথায়? আর মেজাজটা খারাপ হয় যখন দেখি অমুক-তমুক গাড়ির পাস ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে।
ঠিক জাতীয় দলের একজন সাবেক অধিনায়ক যে সুবিধাটা পান না সেটা অন্য কাউকে পেতে দেখলে তাঁর মেজাজ গরম হবেই। খেলোয়াড়দের এই দুঃখবোধটা সব সময়ই থাকে। তাঁরা সৌজন্য টিকিট একটা-দুটা পান, কর্তারা একগাদা। এ সবই সত্য, আপাতদৃষ্টিতে খুবই আপত্তিকর কিন্তু তার মানে কি এই যে সংগঠক বা কর্তারা খেলার মাঠের অপ্রয়োজনীয় জিনিস? একটুও না। খেলোয়াড়রা দেখেন তাঁদের নিয়েই মানুষের উৎসাহ, তাঁদের খেলা দেখতেই উন্মাদনা, এটা মাঝেমধ্যে তাঁদের মধ্যে এই বিভ্রান্তি তৈরি করে যে তাঁরাই তো সব। এই বিভ্রান্তি আমাদের মধ্যেও ছড়ায়, কর্তা বা সংগঠকদের কথা আমরা ঠিক গুরুত্বের সঙ্গে নেই না। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, একজন খেলোয়াড় তো একজন কিন্তু একজন সংগঠক ঠিকপথে চললে শত খেলোয়াড় তিনি তৈরি করতে পারেন। করেছেনও। আপনার পাড়া বা মহল্লায় যখন কোনো প্রতিযোগিতা হয় তখন হয়তো একজন খেলোয়াড়ের কৃতিত্ব দেখে আপনি পুলকিত হন, যে সেরা তাঁকে হাততালি দেন কিন্তু খেয়াল করে দেখুন সেখানেও 'রহিম ভাই', 'আকবর ভাই' কিংবা 'বিধান দা'দের মতো কেউ একজন থাকেন, যাঁর উদ্যোগেই টুর্নামেন্টটা হয়। সেই লোক হাততালি পান না, কেন্দ্রীয় চরিত্র নয় বলে অনেকে নামও জানে না হয়তো কিন্তু এরা না থাকলে খেলা হয় না। খেলা না হলে খেলোয়াড় তৈরি হয় না। সংগঠকরা পেছনে, গোপনে, আড়ালে থেকে এভাবেই খেলা আর খেলোয়াড় দিয়ে আলো করে রাখেন মঞ্চ। সেইসব সংগঠকরা কি আজ আর নেই! আছেন কিন্তু তাঁদের আমরা আর দেখি না। দেখি না কারণ দলবাজ আর লাইনবাজদের ভিড়ে তাঁরা সামনে আসতে পারেন না। গোপন হাহাকার নিয়ে পেছন থেকে আরো পেছনে যান। আমরা দেখি না কিন্তু তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্যে পেছনে যেতে থাকে খেলাও। বাংলাদেশের দুয়েকটা খেলা বাদে বেশির ভাগ যে পেছনের দিকে ছুটছে তার কারণ কি সত্যিকার আর আন্তরিক সংগঠকের অভাব নয়? কারো নাম উল্লেখ করছি না কারণ হাতের কাছে কোনো তৈরি তালিকা নেই; অসাবধানে বাদ পড়ারা আহত হবেন কিন্তু কিছু ছবি কিন্তু ঠিক দেখতে পাই। প্রত্যেকটা জেলায়, প্রত্যেকটা শহরে এক-আধজন খেলাকে নিয়ে সংসার করে বসা এমন এক-আধজন 'পাগল' ছিলেন। আজ! হয়তো আছেন। কিন্তু তাঁদের চেয়ে অমুক-তমুকরা চেয়ার আর পদে এগিয়ে থাকায় তাঁদেরকে হয়তো আমরা চিনিই না।
এখন তাই সংগঠক বলতে তাঁরা যাঁদের সঙ্গে রাজনীতি আছে, যাঁরা অর্থনীতিটা ভালো বোঝেন, পেশির নীতিটাও হয়তো কেউ কেউ জানেন! আর তাই খেলোয়াড়দের একসময় বাধ্য হয়ে খেলা পণ্ড করতে হয়। দাবার গ্র্যান্ডমাস্টাররা খেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি নিয়ে তুঘলকি কারবার চলে! আচ্ছা, আমাদের একজন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আছেন না! একটা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও তো আছে। বিশাল ভবন। অতি সম্প্রতি আরো বিশালাকার নিয়েছে! তাঁদের কাজটা তাহলে কী! ক্রীড়া পরিষদের কাজের কিছু খবর অবশ্য পত্রিকায় আসে মাঝেমধ্যে যখন টেন্ডার নিয়ে গোলমাল হয় কোনো! প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, পৃথিবীর অনেক দেশে ক্রীড়া পরিষদ বলে কিছু নেই, অলিম্পিক কমিটিই ফেডারেশনগুলোর দেখভালের কাজটা করে। আমাদের অলিম্পিক কমিটি আছে, ক্রীড়া পরিষদ আছে, ক্রীড়া অধিদপ্তর আছে, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আছে! এবং আছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীও এবং তাঁদের সঙ্গে দিব্যি টিকে আছেন কিছু কর্তা, যাঁদের খেলা মাঠে থাকুক না থাকুক তাঁরা ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বা ক্রীড়া পরিষদের মনোরঞ্জনটা করতে জানেন।
কাজেই মোকাদ্দেস যে টিকে থাকবেন, হকির খেলোয়াড়রা যে খেলা পণ্ড করবেন, টিটি খেলোয়াড়রা যে ক্ষোভে গলা ফাটাবেন, ব্যাডমিন্টনে যে দলাদলি চলবে_এগুলোর কোনো বিহিত হবে না। খেলোয়াড়দের ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর আমাদের এ লেখা সবই অরণ্যে রোদন।

No comments

Powered by Blogger.