জাতীয় শ্মশানের জমি সাবেক মুসলিম লীগ নেতার দখলে! by আপেল মাহমুদ

পোস্তগোলা জাতীয় মহাশ্মশানের বেশির ভাগ জমি দখল করে নিয়েছেন সাবেক মুসলিম লীগের একজন নেতা। ধীরে ধীরে শত কোটি টাকা মূল্যের ওই জমি দখল করে সেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন শিল্প-কারখানা ও দোকানপাট। জাল দলিলপত্র তৈরি করে অবশিষ্ট জমির মালিকানা পাওয়ারও চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সাবেক মুসলিম লীগ নেতা শফিউল্লাহ শিকদার স্বপন কিভাবে শ্মশানের দেবোত্তর সম্পত্তির মালিক হলেন তা বলতে পারেনি স্থানীয় কেউ। তবে স্থানীয় অনেক বাসিন্দা জানায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকার হিন্দু ও ডোম পরিবারের সদস্যরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী মহাশ্মশানের সব জমি চলে যায় স্বপনের দখলে।


স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা জানায়, শবদাহ চুলি্ল, স্মৃতিসৌধ ও কয়েকটি স্থাপনা স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের চেষ্টায় রক্ষা পায়।
পোস্তগোলা মহাশ্মশান পরিচালনা কমিটির সভাপতি নিতাই চন্দ্র ঘোষ কালের কণ্ঠকে জানান, স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা পাবনার শফিউল্লাহ শিকদার স্বপন কারখানা ও দোকানপাট নির্মাণের নামে শ্মশানের প্রায় তিন বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। এমনকি কয়েক বছর আগে তিনি শ্মশানের একটি বড় পুকুর ভরাট করে সেখানে আল আমিন রি-রোলিং মিলের কারখানা নির্মাণ করেন। শ্মশানের দেবোত্তর সম্পত্তির ওপর প্রায় ৫০টি দোকান তুলে সেখানে পুরনো লোহা ও কাঠ বেচাকেনার মার্কেট বানিয়েছেন।
স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক সদস্য জানায়, শফিউল্লাহ শিকদার স্বপন পোস্তগোলা ছাড়াও নগরীর আরো কিছু জায়গায় দেবোত্তর কিংবা সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি গ্রাস করা সহজ বলে তিনি এ পথ বেছে নিয়েছেন।
মহাশ্মশান কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোপাল চন্দ্র দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, পোস্তগোলার দেবোত্তর সম্পত্তি ছাড়াও রামকৃষ্ণ আখড়ার দুই একর দেবোত্তর সম্পত্তি এবং জুরাইনের আইজি গেট এলাকার আরেকটি আখড়ার জমি দখল করে নিয়েছেন এ মুসলিম লীগ নেতা।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে মতামত জানার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও স্বপনের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। আল আমিন রি-রোলিং মিলের ব্যবস্থাপক পরিচয় দিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি জানান, তাঁর মালিক কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন না।
করিমুল্লাহবাগের স্থায়ী বাসিন্দা খালেদ ইব্রাহিম বলেন, 'বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার থাকা অবস্থায় একজন চিহ্নিত মুসলিম লীগ নেতা শ্মশান, রেল ও সেনানিবাসের জমি অবৈধ দখলের সাহস পায় কোথা থেকে? অথচ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে পরে স্বপন উচ্ছেদ করা জমি আবার দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে ফেলেন।'
এ ব্যাপারে মহাশ্মশান পরিচালনা কমিটির নেতারা জানান, ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুরেও এই অবৈধ দখলদারের হাত থেকে জমি রক্ষা করা যায়নি। প্রশাসনের প্রতিটি টেবিলে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন দখলদার ব্যক্তি।
এ ব্যাপারে ডিসিসির মেয়র সাদেক হোসেন খোকা কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে শ্মশানটি ভূমিদস্যুদের কোপানলে পড়ে। বিভিন্ন মামলার কারণে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তবে শ্মশানের জমি উদ্ধারের জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধারের জন্য যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলে ডিসিসি থেকে সহযোগিতা করা হবে।
পোস্তগোলা শ্মশানে গিয়ে শিল্পী ও লেখক ধ্রুব এষ, মাসুক হেলাল ও উত্তম সেনের দেখা পাওয়া যায়। উত্তম সেনের মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য তাঁরা সেখানে যান। একটি জাতীয় শ্মশানের এ হাল দেখে দুঃখ প্রকাশ করে তাঁরা বলেন, পুরনো লোহা-লক্করের ব্যবসা এবং বিকট আওয়াজের মধ্যেই শবদেহ দাহের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হচ্ছে। শ্মশানের পরিধি এতই সংকীর্ণ যে সেখানে শবদেহ দাহ করার লাকড়ি, বাঁশ, পাটখড়ি, তিল, সরিষা, হরীতকী, ঘি, মধু, সিঁদুর কুলা, রামাবলি, গীতাসহ আনুষঙ্গিক দ্রব্য রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। সব কিছু গাদাগাদি করে রাখতে হয়। নগরীর হিন্দু সম্প্রদায়ের শবদেহ দাহ করার একমাত্র প্রতিষ্ঠানটির দিকে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলেও তাঁরা মন্তব্য করেন।
শ্মশানে চিতা দেখলে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটি অদূর ভবিষ্যতে দখল হয়ে যাবে বলেই কি সেখানে শবদেহ দাহের স্থায়ী চুলি্ল স্থাপন করা হয়নি? দুটি চিতা থাকলেও একটির ওপরে কোনো ছাদ নেই। ফলে ঝড়-বৃষ্টির দিনে সেখানে লাশ দাহ না করে বসে থাকতে হয়। এ ছাড়া লাকড়ি-খড়ি দিয়ে লাশ দাহ করার ফলে শ্মশানের চারদিকে ছাই ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ ব্যাপারে শ্মশানের মোহরার (তত্ত্বাবধায়ক) অপরেশ মণ্ডল জানান, কিছু দিন আগে চিতার ছাই ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণের কারণে পোস্তগোলা সেনানিবাসের উদ্যোগে একটি গ্যাস চুলি্ল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা আর হয়নি। তা ছাড়া ১৯৯৩ সালে সেখানে একটি বৈদ্যুতিক চুলি্ল চালু করা হলেও হঠাৎ করে তা বন্ধ হয়ে যায়। আর সেটি চালু হয়নি।
বৈদ্যুতিক চুলি্ল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং গ্যাস চুলি্ল প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার ব্যাপারে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মূলত শ্মশানের লাকড়ি, পাটখড়ি, ঘি, মধু, বঁাঁশ প্রভৃতি দ্রব্যের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যই বৈদ্যুতিক চুলি্লটি পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কারণ বৈদ্যুতিক চুলি্লতে শবদেহ দাহ করতে এসব দাহ্য পদার্থের প্রয়োজন হয় না। ফলে দাহ খরচও বেঁচে যায়। শুধু ডিসিসির নির্ধারিত ২০ টাকা ফি দিয়েই একটি শবদেহ দাহ করা সম্ভব। বর্তমানে প্রতিটি লাশ দাহ করতে ছয় মণ লাকড়ি বাবদ এক হাজার ৮০০ টাকা, দুটি বাঁশ বাবদ ৫০০ টাকা, পাটখড়ি বাবদ ৫০০ টাকা, তিল, সরিষা, ঘি, গীতা প্রভৃতি বাবদ এক হাজার টাকা এবং পুরোহিতের 'দক্ষিণা' বাবদ ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। শ্মশানের মধ্যেই ডিসিসি ও ডোমরা এসব ব্যবসা করছে। গ্যাসের চুলি্ল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যাঁকে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁর গ্যাস নিয়ে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে ওই প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে বলে জানান শ্মশানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি।
মহাশ্মশানের রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, ১৮৭৬ সালে মোট সাড়ে ছয় বিঘা জমির ওপর দেশের সর্ববৃহৎ মহাশ্মশান গড়ে ওঠে বুড়িগঙ্গার উত্তর তীরে পোস্তগোলার করিমুল্লাহবাগে। সূত্রাপুরের জমিদার গোবিন্দ চন্দ্র দত্ত ওই জমি দান করেন শ্মশানের জন্য। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শবদাহ করার ব্যবস্থা রয়েছে। শবদেহ দাহ ছাড়াও হিন্দু সম্প্রদায়ের মোহান্ত, যোগী, নাথ, হরিজন, বৈষ্ণব, মাদ্রাজি, রবিদাস, কানপুরী, সাধু-সন্ন্যাসী এবং ১২ বছরের কম বয়েসী যেকোনো সম্প্রদায়ের শিশুদের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ওই মহাশ্মশানে। কিন্তু অবৈধ দখলের কারণে সৎকারের কাজে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান মহাশ্মশানের মোহরার। অপরেশ মণ্ডল আরো জানান, শ্মশানের যে অংশে লাশের সৎকার করা হয়, তাতে জমির পরিমাণ ১৩ কাঠা। শ্মশানের অপর অংশে রয়েছে ২৭ কাঠা জমি।
জানা যায়, শবদেহ সমাধিস্থ করার জন্য খাতাপত্রে ১৩ কাঠা জমি থাকলেও অধিকাংশ জায়গা সমাধি মন্দির, স্মৃতিসৌধ ও মন্দির নির্মাণের নামে দখল করে নেওয়া হয়েছে। সেখানে মাত্র চার কাঠা জমি অক্ষত রয়েছে। এর মধ্যে মৃতদের কবর দিতে হচ্ছে। মহাশ্মশানের মোহরার অপরেশ মণ্ডল জানান, হিন্দু ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শবদেহ সমাধিস্থ করার জমিতে যে স্মৃতি মন্দির ও দেবতার মন্দির স্থাপন করা হয়েছে তা অবৈধ। কারণ শ্মশানের জমিতে শবদেহ দাহ কিংবা কবর দেওয়া ছাড়া আর কোনো স্থাপনা নির্মাণের নিয়ম নেই। তিনি জানান, প্রতি মাসে সেখানে ২৫টি লাশ সমাহিত করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। জায়গা স্বল্পতার জন্য অনেক সময় একটি লাশের ওপর আরেকটি লাশ সমাহিত করতে হয়।

No comments

Powered by Blogger.