ফের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ-আখাউড়ায় গুচ্ছগ্রামে দুই যুগ ধরে অশান্তি by বিশ্বজিৎ পাল বাবু,

রশাদের গুচ্ছগ্রাম, লও লও সালাম'। আশির দশকের শেষ দিকের একটি স্লোগান। সরকারি খাসজমি ভূমিহীনদের মাঝে বরাদ্দ দিয়েছিল তৎকালীন এরশাদ সরকার। সারা দেশের মতো আখাউড়ার দুর্গাপুর গ্রামে ২৫ ভূমিহীনকে গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। আর এ বিষয়টি অশান্তি বয়ে আনে দুর্গাপুর গ্রামে।গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই যুগ ধরেই চলছে এ অশান্তি। হামলা-মামলা থেকে খুন। একদিকে গুচ্ছগ্রামবাসী ও তাদের সমর্থিতরা, অন্যদিকে গুচ্ছগ্রামের জায়গার মালিকানা দাবি করা সহিদ আলী ও তাঁর সমর্থকেরা।


সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার খুন হন সহিদ আলীর চাচাতো ভাই মাওলা আলী। পরিবারের অভিযোগ, গুচ্ছগ্রামবাসী ও তাদের নেতৃত্বদানকারীরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এ ঘটনার জের ধরে গত বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার সকালে চলে গুচ্ছগ্রামের বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ। এ ছাড়া গুচ্ছগ্রামের বাইরেও আরো কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটে। সহিদ আলীর পক্ষের লোকজনই এ তাণ্ডব চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা।
ঘটনার পর থেকে এলাকাজুড়েই আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে রয়েছে র‌্যাব ও পুলিশের দল। কোনো ঘটনায়ই শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। তবে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ দুই নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে।
খড়মপুর মাজার শরীফ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে মাওলা আলীর লাশ দাফন হয়। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে তাঁর লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। মাওলা আলী ছিলেন তাঁর ছেলে খানজাহান আলী হত্যা মামলার বাদী। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে একই প্রতিপক্ষের হাতে খানজাহান চলতি বছরের ১৪ জুন খুন হন।
এদিকে শুক্রবার সকালে দুর্গাপুরে গিয়ে দেখা যায়, লুটতরাজ আর অগি্নসংযোগের দৃশ্য। তখনো গুচ্ছগ্রামে পোড়া গন্ধ। এরই মধ্যে সকাল ১১টার দিকে আরো অন্তত আটটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের সহায়তায় কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সকাল থেকেই র‌্যাব ও পুলিশের দুটি দল সেখানে টহল দেয়। একপর্যায়ে পুলিশ মাইকিং করে গ্রামের লোকজনকে ঘরের ভেতর চলে যেতে বলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুচ্ছগ্রাম ও এর আশপাশের আবু মিয়া, নুরুল ইসলাম, স্বপন মিয়া, মো. শাহ আলম, মো. রফিক মিয়া, সাদ্দাম মিয়া, বাচ্চু মিয়া, আশরাফ খাদেম, ফায়েজ আলী, মনসুর মিয়া, আতর আলী, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল কাদির মনু, আবুল খায়েরেরসহ অন্তত অর্ধশত বাড়িতে অগি্নসংযোগ ও লুটতরাজ করা হয়েছে। ওই বাড়ির পুরুষরা ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
দুপুর ১২টার দিকে মাওলা আলীর লাশ বাড়িতে নিয়ে এলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শোকাহত স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মাওলার মেয়ে রেখা বলেন, 'আমার ভাইকেও আমার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একইভাবে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। আর কত লাশ চায় ওরা। আমি আমার বাবা ও ভাইয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।'
দুর্গাপুর গ্রামের আরিফুর রহমান খাদেম ও মনির মিয়া অভিযোগ করেন, পুলিশ সঠিক ভূমিকা রাখলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘটনার পরপর পুলিশ সেখানে এলেও তারা ছিল দর্শকের ভূমিকায়। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই পুলিশের সহায়তা চেয়ে পায়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য সানিয়া আক্তার বলেন, 'আমাদের পরিবারের কেউ কোনো পক্ষের নয়। তার পরও কেন আমাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হলো বুঝতে পারছি না। তিলে তিলে করে গড়া আমাদের সবকিছু ওদের এক আগুনেই শেষ হয়ে গেল। আমার মা পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েও পাননি। আমারই বা দোষ কী ছিল। তারা কেন আমার প্রবেশপত্রটি পুড়িয়ে দিয়েছে। আগামী ১৭ তারিখ কিভাবে আমি বিএসএস পরীক্ষায় অংশ নেব।'
শুক্রবার সকালে আগুন লাগানোর পর খোলা আকাশের নিচে কোলের শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গুচ্ছগ্রামের রুবি বেগম বলেন, 'সরকার থেকে জায়গা বরাদ্দ পেয়ে আমরা এখানে থাকছি। প্রতিপক্ষের লোকজন মামলা-হামলা করে হয়রানি করছে। এখন আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে আমাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে।'
এ ব্যাপারে সহিদ আলীর ছেলে মো. সেলিম মিয়া বলেন, 'গোবিন্দ দাস মন্তু নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিনিময় সূত্রে আমার বাবা ১০২ দাগের এক একর ৩০ শতক জায়গার মালিক। সরকার ১৯৮৯ সালের দিকে আমাদের জোরপূর্বক সরিয়ে দিয়ে গুচ্ছগ্রামের লোকজনকে জায়গা করে দেয়। এখন আমাদের প্রায় ৫০ শতক জায়গা বেদখল হয়ে আছে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে মামলা চলছে। সর্বশেষ উচ্চ আদালতের একটি রায়ও আমাদের পক্ষে আসে। জায়গা হারানোর ভয়ে গুচ্ছগ্রামের লোকজন আমাদের ওপর অত্যাচার করে যাচ্ছে।'
সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মহসীন মিয়া মন্টু বলেন, 'কাগজপত্র অনুযায়ী সহিদ আলীর চাচা বাসু মিয়া এক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে বিনিময়ের মাধ্যমে জায়গাটির মালিক। অন্যদিকে ১৯৮৮-৮৯ সালে সরকার ওই জায়গা ভূমিহীনদের মাঝে বরাদ্দ দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হামলা-মামলা লেগেই ছিল। আমরা বেশ কয়েকবার মীমাংসার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।'
আখাউড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. নুরুল হক ভুঁইয়া বলেন, 'এরশাদ সরকারের শাসনামলে গুচ্ছগ্রাম দেওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি আদালতের একাধিক রায় সহিদ আলীর পক্ষে আসে। কয়েক মাস আগে আমরা দুই পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলাম। এরই মধ্যে দুটি খুনের ঘটনা ঘটল। পরবর্তীকালে যেভাবে বাড়িতে আগুন লাগানোসহ লুটপাট করা হয়েছে, এমন ঘটনাও আখাউড়ার ইতিহাসে বিরল। সব মিলিয়ে এ নিয়ে কথা বলার ভাষা নেই।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, সরকারই মূলত এ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূলে। জায়গা নিয়ে সমস্যা থাকলে কেনই বা গুচ্ছগ্রামবাসীকে এখানে পুনর্বাসন করা হলো।' অনেকের মতে, বিরোধপূর্ণ জায়গায় অনেক আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ছিল। জায়গাটি ছিল এক মহারাজের। আখাউড়া ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ আক্কাস আলী বলেন, 'আজ (শুক্রবার) সকালে নতুন করে লাগানো মোট আটটি ঘরের আগুন নেভানো হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার নিরাপত্তাজনিত কারণে আগুন নেভাতে না পারায় অন্তত অর্ধশত ঘর পুড়ে যায়।'
আখাউড়া থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম জানান, বিকেল ৫টা নাগাদ কোনো পক্ষই থানায় মামলা দেয়নি। নতুন করে কাউকে গ্রেপ্তারও করা যায়নি। তিনি জানান, শুক্রবার বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ একদিকে গেলে অন্যদিকে লোকজন আগুন লাগিয়ে দিলে বিপাকে পড়তে হয়।
সহকারী পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) বি এম নুরুজ্জামান বলেন, 'এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এখানে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। আশা করি, নতুন করে আর কোনো ধরনের ঘটনা ঘটবে না। ঘটে যাওয়া ঘটনায় (খুন ও অগি্নসংযোগ) আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
পুলিশের গাফিলতি প্রসঙ্গে এএসপি নূরুজ্জামান বলেন, 'এটা ঠিক নয়। পুলিশের সামনে কোনো ঘটনা ঘটেনি। হয়তো প্রথম দিকে পুলিশের সংখ্যা কম ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় পরে সংখ্যা বাড়ানো হয়।'
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শাহ আলম বলেন, 'কিছুদিন আগেও আমি এ বিষয়ে মীমাংসা করতে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এরই মধ্যে আবারও এমন ঘটনা ঘটে গেল। বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবার মীমাংসার উদ্যোগ নেব।'

No comments

Powered by Blogger.