জবাই না করে কোরবানির ২৬ গরু দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ by হায়দার আলী ও সুমন

রসিংদীর বেলাব উপজেলার ভাটেরচর গ্রাম। জেলা শহর থেকে দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। প্রান্তিক এ গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষিকাজ। দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী বলে অনেকের নিজেদের হালের গরুই নেই। তবে এবারের ঈদুল আজহা বেশ কয়েকটি পরিবারের জন্য এসেছে নতুন বার্তা নিয়ে। বেশ কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে কোরবানির গরু। একটি সংগঠন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ভাটেরচরসহ আশপাশের এলাকার ২৬টি দরিদ্র পরিবারকে গাভী ও বকনা বাছুর কিনে দিয়েছে। এ উদ্যোগকে এলাকার বহু মানুষ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তাঁরা বলছেন, অনেকেই একাধিক পশু কিংবা অনেক টাকায় কেনা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন।


এখানে ব্যয় সংকোচন করে সে টাকায় গবাদি পশু কিনে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিলে দেশের অনেক পরিবার উপকৃত হবে।
খবর পেয়ে ঈদের পর ভাটেরচর গ্রামে গিয়ে জানা যায়, হাক্কানী মিশন নামের একটি সংগঠন অভূতপূর্ব এ উদ্যোগ নেয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর বেশি বেশি গরু, ছাগল কোরবানি দিলেও এবার কম সংখ্যক পশু কোরবানি দিয়েছে। এভাবে টাকা বাঁচিয়ে তারা কয়েকটি গ্রামের দরিদ্র মানুষের মাঝে গাভী, বকনা বাছুর কিনে বিলিয়ে দিয়েছে।
ভাটেরচর গ্রামের স্বামী পরিত্যক্ত দেলোয়ারা বেগম এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে বেঁচে আছেন। এবার ঈদে স্থানীয় কাজলডাঙ্গা আস্তানা শরিফ থেকে একটি বকনা বাছুর পেয়ে তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। বাছুরটিকে যত্ন করার ফাঁকে দেলোয়ারা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জমিজমা কিছু নেই। অন্যের জমিতে কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে আছি। বাছুরটি পাওয়ার পর এখন আমার ইচ্ছা তাকে বড় করে গাভী গরু করা। এতে গাভীর দুধ বিক্রি করে সংসারের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করব।'
শুধু দেলোয়ারা বেগম নন, বেলাব উপজেলার দড়িকান্দি গ্রামের বাচ্চু মিয়া, জজ মিয়া, ভাটেরচর গ্রামের সোহরাব হোসেন, আলতাব হোসেন, আলকাস মিয়া, জঙ্গুয়া গ্রামের আলী নেওয়াজ কাজলসহ দুলালকান্দি, চর উজিলাব, লক্ষ্মীপুর ও রায়পুরা উপজেলার শিবপুর গ্রামের ২৬টি দুস্থ পরিবারকে বকনা বাছুর, গাভী দিয়েছে স্থানীয় কাজলডাঙ্গা আস্তানা শরিফ। গত মঙ্গলবার ভাটেরচর গ্রামে হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এসব পশু বিতরণ করে।
কাজলডাঙ্গা আস্তানা শরিফের সভাপতি জাহানুল হক বাবুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কমান্ডার (অব.) আবদুর রউফ, বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রেসসচিব আমিনুল হক বাদশাহ, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের মহাপরিচালক মোনায়েম সরকার, আশিক্বীনে আউলিয়া ঐক্য পরিষদের নির্বাহী উপদেষ্টা আল্লামা মোহাম্মেদ সাদেক নূরী, ভৈরব পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাস, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সহচর ইফতেখার উদ্দিন খান খসরু, নরসিংদী প্রেসক্লাবের সভাপতি নিবারণ রায় প্রমুখ। কোরবানির কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে দরিদ্রদের যাঁরা সাহায্য করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন শেখ আমজাদ হোসেন, সেলিম উদ্দিন আহামেদ, শেখ মজলিশ ফুয়াদ, জাহানুল হক, শেফালী বাহার, প্রীতিলতা, সিলভিয়া হক, নজরুল ইসলাম, নীরা বেগম, রাবেয়া আক্তার প্রমুখ।
হাক্কানী মিশন বাংলাদেশের সভাপতি ড. এমদাদুল হক কাজল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশে এমন বহু পরিবার আছে যাদের কাছে ঈদুল আজহার দিনে একটি পশু কোরবানি করার চেয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করার মতো সক্ষম একজন ব্যক্তি অনেক বেশি প্রয়োজনীয় ও বরণীয়। তাই আমাদের পশু কোরবানির টাকাটা যদি ওই ব্যক্তিটিকে দিই এবং সে যদি একজন সক্ষম ও উপার্জনক্ষম ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে, সেটিই হবে উত্তম। আর এ ব্যবস্থাই পশু কোরবানির বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। সম্ভবত নিজের সমসাময়িক মুসলিম সমাজের জন্য এ জাতীয় একটি কল্যাণবোধ থেকেই হযরত বিলাল (রা.) এই রীতিটির প্রচলন ঘটিয়েছেন।' তিনি দাবি করেন, পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় কোরবানির ঈদে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি কোরবানি দেওয়া হয়।
কাজলডাঙ্গা আস্তানা শরিফের সভাপতি জাহানুল হক বাবুল বলেন, 'মানুষ যদি সীমিত কোরবানি দিয়ে অবশিষ্ট টাকায় গরিব ও দুস্থ মানুষকে সহযোগিতা করে তাহলে একদিকে কোরবানির নামে গণহারে পশু জবাই রোধ হবে পাশাপাশি গরিবের কল্যাণ হবে। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবারই প্রথম আমরা ২৬টি দুস্থ পরিবারের মধ্যে বকনা বাছুর বিতরণ করেছি। এর মাধ্যমে ওই পরিবারগুলোর স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।'
এ উদ্যোগে যাঁরা শামিল হয়েছেন তাঁদের একজন শেখ আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, 'প্রতিবছর কোরবানি দিই, এবারও দিয়েছি, তবে কম টাকায় দিয়েছি। ঈদুল আজহার দিন দরিদ্র মানুষকে গরু অনুদান হিসেবে দিয়েছি, যেন দরিদ্র মানুষ সচ্ছলভাবে চলতে পারে।'
বেলাব উপজেলার ভাটেরচর, দড়িকান্দি ও দুলালকান্দি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, কোরবানির ঈদে বাছুর পাওয়া দরিদ্র পরিবারগুলো খুশি। অনেকেই বাছুর পেয়ে তা লালনপালনের জন্য ঘর তৈরি করেছেন। সবাই তাঁদের কৃষিকাজের পাশাপাশি বাছুরটির বাড়তি যত্ন নিচ্ছেন। আদর করে খড় ও ভুসি খাওয়াচ্ছেন।
জঙ্গলী গ্রামের আলকাস হোসেন বলেন, 'কোরবানির ঈদে গরুর মাংস খাইতেও সমস্যা হয়, সেখানে আস্ত একটা গরু পেয়েছি। এ গরু থেকে পরিবারের আয়-উন্নতি বাড়লে সংসারের কষ্ট দূর হবে।' দড়িয়াকান্দি গ্রামের জজ মিয়া বলেন, 'আমাগো মতো গরিব মানুষরে যদি সারা দেশ এমনভাবে উপকার করত তাইলে আস্তে আস্তে গরিব লোকের সংখ্যা কইম্যা যাইতো, যেই বাকনা বাছুর দিছে, এইড্যা এক বছর পালন করলেই গাই গরু হইয়া যাইবো, তহন আর আমাগো কষ্ট থাকব না।'
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বকনা বাছুর পেয়ে খুশি দড়িকান্দি গ্রামের রাফিয়া বেগম। তিনি বলেন, 'কয়েক বছর যাবৎ গরু নাই। আল্লাহর নামে এই বাছুরটি পেয়েছি। আল্লাহ যদি রাখে তাহলে বাছুরটিকে বড় করব। আর যাঁরা কোরবানির টাকা বাঁচিয়ে আমাদের গরিবদের গরু কিনে দিয়েছেন, তাঁদের জন্য দোয়া করব।' একই গ্রামের আলতাব হোসেন বলেন, 'এবারের ঈদে গরু পাওয়ায় অনেক খুশি হয়েছি। এখন গরুটিকে বড় করে বাজারে বিক্রি করব। আশা করি, গরু পালনের মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আসবে।'
কোরবানির টাকা বাঁচিয়ে দুস্থ ও গরিব মানুষকে গরু কিনে দেওয়াকে ভালোভাবেই নিয়েছে গ্রামের মানুষ। দড়িকান্দি গ্রামের মোরশেদ মিয়া বলেন, 'কেউ যদি কোরবানি থেকে টাকা বাঁচিয়ে গরিব মানুষের উপকার করে তাহলে অবশ্যই তা ভালো কাজ।' এ ধরনের কাজ দেশের সব স্থানে হলে দরিদ্রতা দূরীকরণে তা ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
ভৈরব পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাস বলেন, 'কোরবানি থেকে টাকা বাঁচিয়ে গরিব মানুষকে দিলে তারা স্বাবলম্বী হবে। মানুষের কল্যাণে এমন কাজ অবশ্যই মহৎ। এভাবে যদি আরো অনেকে করত তাহলে গরিব মানুষ গরু পালন করে একসময় সেই টাকা সঞ্চয় করতে পারত।'

No comments

Powered by Blogger.