পরিবহন ভাড়া বাড়াতে চাপ-পুনর্নির্ধারণের আগেই আদায় হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া by পার্থ সারথি দাস

জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে চাপ দিচ্ছেন পরিবহন নেতারা। জানা গেছে, এ নিয়ে আগামীকাল রবিবার যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের বৈঠকে বসার কথা। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গণপরিবহনের নতুন ভাড়া নির্ধারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তত্ত্বাবধানে সংস্থার ১২ সদস্যের একটি কমিটি বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখছে।


এদিকে জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়ানোর পর গতকাল শুক্রবার নগরীর গণপরিবহনে হঠাৎ করেই বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এতে যাত্রীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় হলেও এই 'ভাড়া-সন্ত্রাস' রোধে বিআরটিএ ছিল নীরব।
অন্যদিকে ভাড়া বাড়ানোর একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়েও। দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সংস্থাটিকে লোকসান থেকে টেনে তুলতে তৈরি করা হয়েছে এ প্রস্তাব। গত মাসে তৈরি করা এ প্রস্তাবে ৪০-৫০ শতাংশ হারে ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে ছয় মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম তিন দফা বাড়ানো হলো। এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর এবং তারও আগে গত ৫ মে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এরই মধ্যে সিএনজির দাম বাড়ানোরও আভাস দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হতে পারে শতকরা ৭০ ভাগ। জ্বালানির দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়ানো হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর এবং এর আগে ১৯ মে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী গাড়ির যন্ত্রাংশ, আমদানি ব্যয়, জ্বালানিসহ ১৬টি বিষয় বিবেচনা করে নতুন ভাড়া নির্ধারণের বিধান রয়েছে। কিন্তু জ্বালানির দাম বাড়ানো হলেই পরিবহন মালিকদের চাপে পরিবহনের নতুন ভাড়া নির্ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে থেকেই পরিবহন নেতারা যোগাযোগমন্ত্রীকে ভাড়া বাড়ানোর কথা বলতে শুরু করেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আবারও গণপরিবহনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এ জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে রবিবার একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় পরিবহন খাত এখন বিপর্যয়ের মুখে। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বাস ও মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি মাত্র পাঁচ পয়সা বাড়িয়েছিল। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় প্রথম দুই কিলোমিটারের পর থেকে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়ানো হয় মাত্র ১৪ পয়সা। তিনি বলেন, 'আমরা ওই ভাড়ার হার প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কারণ, শুধু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ওই সময় ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবারও জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর_এই সময়ের মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। এ কারণে বাস-মিনিবাসে দিনে এখন বাড়তি ব্যয় হবে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া গাড়ির টায়ার, লুব্রিকেন্টস ও খুচরা যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। করও বাড়ানো হয়েছে। যেমন আমদানি করা টায়ারের ওপর কর শতকরা ১২ থেকে ২৫ টাকা করা হয়েছে। এসব কারণে আমরা ২২টি ক্যাটাগরি বিবেচনায় রেখে এবার আবারও ভাড়া বাড়ানোর জন্য যোগাযোগমন্ত্রী ও বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে গত বৃহস্পতিবার মৌখিক প্রস্তাব রেখেছি।'
বিআরটিএর পরিচালক সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে গত বৃহস্পতিবারও একটি বৈঠক হয়েছে। তাদের ভাড়া না বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে বিআরটিএর পক্ষ থেকে। টায়ার আমদানি কর ১৩ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এটি কমানোর দাবি জানিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। এটি আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই হার কমানো হলে তাঁরা পরিবহনের ভাড়া বাড়াবেন না_এমনটাই আশা করছেন নীতিনির্ধারকদের অনেকে। কিন্তু তার পরও পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানাতে পারেন। কোনোভাবে তাঁদের মানাতে না পারলে ভাড়া বাড়ানোর জন্য ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটিকে প্রস্তাব তৈরি করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী সিএনজির দাম বাড়ানোর আভাস দেওয়ায় সিএনজিচালিত পরিবহন মালিকরা তাঁদের পরিবহনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের দাবি জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ও ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন নয়ন কালের কণ্ঠকে বলেন, সিএনজির দাম গত ১২ মে শতকরা ৫০ ভাগ এবং গত ১৯ সেপ্টেম্বর শতকরা ২০ ভাগ বাড়ানো হয়েছিল। এখন শতকরা ৭০ ভাগ বাড়ানোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই অবস্থায় সিএনজির নতুন দাম ঘোষণার আগে নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানির আয়োজন করতে হবে। সঠিক ব্যাখ্যা না দিলে এই ঘোষণা কেউ মেনে নেবে না।
গণপরিবহনে দফায় দফায় ভাড়া বাড়ে : যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে সিএনজি অটোরিকশা চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত চার দফা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। চার মাসের ব্যবধানে বাড়ানো হয় দুই দফা। মে মাসের পর সর্বশেষ গত ১৯ সেপ্টেম্বর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় প্রথম দুই কিলোমিটারের পর থেকে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়ানো হয় ১৪ পয়সা।
এ ছাড়া গত মে মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ পয়সা। ওই সময় বাস ভাড়া আগের এক টাকা ২০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে এক টাকা ৫৫ পয়সা করা হয়েছিল। গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে তা পাঁচ পয়সা বাড়িয়ে করা হয় এক টাকা ৬০ পয়সা। এ ছাড়া মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারের জন্য যাত্রীপ্রতি ভাড়া এক টাকা ১০ পয়সা থেকে ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে এক টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয় গত মে মাসে। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে তা পাঁচ পয়সা বাড়িয়ে করা হয়েছে এক টাকা ৫০ পয়সা। এ ছাড়া বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সাত টাকা এবং মিনিবাসে পাঁচ টাকা।
গতকাল সকালে মিরপুর থেকে সদরঘাট যেতে সিএনজি অটোরিকশাচালক আরব আলী এ প্রতিবেদকের কাছে ৫০০ টাকা ভাড়া দাবি করেন। তিনি বলেন, 'মিটার নষ্ট। মিটারের ভাড়ায় গেলে পোষায় না। বৃহস্পতিবার রাত থেকে তেলের দাম বেড়েছে। তাই বেশি ভাড়া।' কিন্তু সিএনজির দাম না বাড়ার বিষয়টি তাঁকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, 'পুলিশের মোবাইল টিম ধরলেই ১০০ টাকা দিতে হয়। মালিকের জমা ৭৫০ টাকা। যাত্রীও কম, তাই ভাড়া বেশি।'
গতকাল রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেট এলাকায় এভাবে সিএনজি অটোরিকশাচালকদের দ্বিগুণ পর্যন্ত ভাড়া নিতে দেখা গেছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধ করতে নীরব রয়েছে বিআরটিএ। সংস্থার পরিচালক (প্রশাসন) তপন কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মাত্র দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এত গাড়িতে অভিযান চালানো যায় না। আমরা সাধ্যমতো অভিযান চালাই।'
রেলওয়ের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব : 'রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আবু তাহের গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, '১৯ বছরেও রেলের ভাড়া বাড়েনি। আমার জানা মতে, ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবটি এখনো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আছে। এটা সত্যি যে রেলওয়ের কাছে যাত্রীদের প্রত্যাশা বাড়ছেই। কিন্তু রাজস্ব খাতে বরাদ্দ কম থাকায় যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নিতে পারছি না। যাত্রীসেবার মান বাড়িয়ে দ্বিগুণ ভাড়া নিলেও যাত্রীদের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না। তবে আমাদের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করলে তবেই কার্যকর করতে পারব।'
রেলওয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী প্রতিবছর রেলওয়েকে ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে। সর্বশেষ ১৯৯২ সালের ১ মার্চ রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। তখন ডিজেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ১৩ টাকা ৭০ পয়সা। এখন ডিজেলের দাম ৫৬ টাকা।
একাধিক পরিবহন সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, রবিবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকটি মাত্র কয়েকজনকে নিয়ে অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। সেখানে পরিবহন শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ছাড়াও ভাড়া পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। তবে অনেক পরিবহন নেতা বিষয়টি জানেন না। অনেক নেতা আবার ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী খান গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যোগাযোগমন্ত্রী রবিবার তাঁর লোকজন নিয়ে বসবেন শুনেছি। তবে আমি সেখানে যাব না। আমাদের বহু দাবি এখনো পূরণ হয়নি।'

No comments

Powered by Blogger.