আপিল বিভাগের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিচারক নিয়োগ চলছে : চুপিসারে বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে : খন্দকার মাহবুব : নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও কলুষিত হয়েছে : ড. শাহদীন মালিক by আলমগীর হোসেন

র্তমান সরকার পৌনে তিন বছরে ৫৬ জন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। এ সংখ্যা ১০০তে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের। মামলার জট নিরসনে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন আইন মন্ত্রী। অথচ আইনে নির্দিষ্ট থাকা সত্ত্বেও আপিল বিভাগে তিনটি শূন্য পদে বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকরা হাইকোর্টের বিচারকদের জ্যেষ্ঠ তালিকায় না থাকায় এ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বিচারক নিয়োগ নিয়ে আপিল বিভাগের রায় মান্য করা হচ্ছে না আইন বিশেষজ্ঞদের এ ধরনের অভিমত থাকা সত্ত্বেও থেমে থাকেনি নতুন বিচারক নিয়োগ।


আপিল বিভাগের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিচারক নিয়োগ চলছে।বিএনপির বিগত ৫ বছরের শাসনামলে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি পদে ৩৯ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ আমলে বিচারকের সংখ্যা ৫৬-এ দাঁড়িয়েছে। অক্টোবরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দশজনকে নিয়োগ দেয়া হয়।
আইন মন্ত্রণালয় ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস সূত্রে জানা গেছে, অচিরেই আরও বিচারক নিয়োগ দেয়া হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের একজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, মামলা জট নিরসনে আরও বিচারপতি নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। অন্তত আরও ৫০ জন বিচারক নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরই মধ্যে এনেক্স ভবনে আরও এজলাস বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু
হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাইকোর্টে প্রায় ৪০ জন বিচারপতি বসার একক কোনো এজলাস কক্ষ নেই। একটি কক্ষে দুইজন কোনো কোনো কক্ষে তিনজন করে বিচারক বসছেন। বিচারকদের বাসস্থানের সঙ্কট রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সঙ্কট রয়েছে বিচার কক্ষের। বর্তমানে এনেক্স ভবন ও মূল ভবন মিলিয়ে বিচার কক্ষ রয়েছে ৫০টি। এজলাস কক্ষের সঙ্কট নিরসনে দুই সপ্তাহ আগে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে চারটি এজলাস নির্মাণ করা হয়। নতুন বিচারক নিয়োগের বিষয়টি মাথায় রেখে আরও এজলাস কক্ষ নির্মাণ করা হচ্ছে।
বিচারক নিয়োগে ৪০ বছরে কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি। নীতিমালা না হওয়ার সুযোগে যথেচ্ছভাবে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে দশ বিচারক খ্যাত মামলায় হাইকোর্ট একটি রায় দেয়। এই রায় আপিল বিভাগও বহাল রাখে। রায়ে বলা হয়, বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানোর আগে প্রধান বিচারপতি উভয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। রায়ে বলা হয়, বিচারক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির আইনি বুদ্ধি প্রকর্ষ বা লিগ্যাল অ্যাকুমিন এবং উপযুক্ততা নিশ্চিত করবে সুপ্রিমকোর্ট। এ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির কাছে যে মতামত দেবেন সেই বিষয়ে প্রধান বিচারপতির মতামতই প্রাধান্য পাবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, অক্টোবর মাসে দুই দফায় ১০ জন বিচারপতি নিয়োগ চুপিসারে সম্পন্ন হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বারের সিনিয়র আইনজীবী এবং সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত নেতৃত্বের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা করেননি।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এখন বিচারপতি নিয়োগ হচ্ছে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে। চুপিসারে এ কাজ করা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি নিজেই উচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করেননি। অথচ এ রায় মানা সবার জন্যই বাধ্যতামূলক-যতক্ষণ না অন্য কোনো রায়ের মাধ্যমে ওই রায় পরিবর্তিত না হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, এরই মধ্যে যে ১০ জন বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে প্রধান বিচারপতি তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করার প্রয়োজনবোধ করেননি।
ব্র্যাক স্কুল অব ল’র পরিচালক ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর সবাই আশা করে ছিল বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তত স্বচ্ছতা আসবে। কিন্তু তা তো হয়নি বরং নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও কলুষিত হয়েছে। দলীয়করণ বেড়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরাই বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। এ ব্যতিক্রম হতে দেখা যায়নি। প্রধান বিচারপতি তো কোনো দলের নয়। কিন্তু তিনি যাদের নাম সুপারিশ করছেন তাদের সবাই আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে তার এই সুপারিশ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
অপরদিকে আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়েছে ১১তে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বিচারক রয়েছেন ৮ জন। ১১ জন বিচারক নিয়োগ পেলে আপিল বিভাগে আরও তিনটি বেঞ্চ গঠন করা যেত। কিন্তু বিচারক স্বল্পতার কারণে একটি মাত্র বেঞ্চে বিচারকার্য চলছে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারকদের আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু আমাদের দাবি মান্য করা হচ্ছে না। এ সরকারের আমলে মাত্র একবারই আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা ১১ ছিল। বেশ কয়েকজন বিচারক অবসরে চলে যাওয়ায় এখন তিনটি পদ শূন্য রয়েছে। জ্যেষ্ঠ বিচারকদের তালিকায় আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকরা না থাকায় এ নিয়োগ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

No comments

Powered by Blogger.