টঙ্গীর দত্তপাড়া পুনর্বাসনকেন্দ্র-বরাদ্দের আগেই দখল চলছে 'বেচাকেনা' by মো. মাহবুবুল আলম,

ঙ্গীর দত্তপাড়া এরশাদনগর বাস্তুহারা পুনর্বাসনকেন্দ্রের ৩ নম্বর ব্লকে ১৩০ নম্বর প্লটে দুই কাঠা জমির ওপর তৈরি একটি বাড়ি একসময় দখলি সূত্রে ভোগ করতেন হারুন-অর-রশিদ নামের এক ব্যক্তি। সম্প্রতি তিনি সিরাজুল ইসলাম নামের এক বাঁশ ব্যবসায়ীর কাছে বাড়িসহ জমিটি বিক্রি করে দিয়েছেন। জমি বিক্রি করতে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, এখানে এর কিছুই করা হয়নি। কেবল ৫০ টাকার একটি স্ট্যাম্পে কয়েকজনকে সাক্ষী রেখে জমি হাতবদল হয়েছে মাত্র।


বর্তমান বাজারদরে এ জমির দাম আনুমানিক ২০ লাখ টাকা থাকলেও হাতবদল হয়েছে মাত্র পাঁচ লাখ টাকায়। এর কারণ, এটি সরকারি সম্পত্তি। বরাদ্দ হওয়ার আগেই উঠে পড়েছিল বাস্তুহারা লোকজন। তাদের কাছ থেকে পানির দরে এর দখল নিয়েছে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। সেই থেকে কেবল হাতবদল হয়ে আসছে জমিটি। কেননা এটি বিক্রি করার এখতিয়ার কারো নেই।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও টঙ্গী পৌরসভা দখলদারদের এই দৌরাত্ম্য সম্পর্কে জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পুনর্বাসনকেন্দ্রটি এখন যেন 'মগের মুল্লুক'। কার সম্পত্তি কে 'বেচে' (হাতবদল) এর কোনো হিসাব নেই। এভাবে বাস্তুহারা জনগোষ্ঠীর জন্য স্থাপিত পুনর্বাসনকেন্দ্রটি চলে যাচ্ছে বিত্তশালীদের দখলে।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চার হাজার ৪৪৪টি অসহায় ছিন্নমূল পরিবারকে দত্তপাড়ায় ১০১ একর অব্যবহৃত তৎকালীন ডিআইটির হুকুমদখলকৃত জমিতে এনে ঠাঁই দিয়ে পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। পুনর্বাসনকেন্দ্রের জমি সমবণ্টন ও এলাকার উন্নয়নে ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর থেকে চার বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুসারে এখানে দুটি কক্ষ, বাথরুম ও রান্নাঘর সংবলিত ৬০০ বর্গফুটের চার হাজার ইউনিট নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে ৮৩ লাখ টাকা ও ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে এক হাজার ১৯টি ইউনিটের নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর প্রকল্পের কাজ স্থগিত হয়ে যায়। নির্মিত এসব সেমিপাকা বাড়ি স্বল্প আয়ের লোকদের মধ্যে ৯৭ হাজার টাকায় ১৫ বছর মেয়াদি কিস্তিতে স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়ার কথা। কিন্তু নির্মিত বাড়িগুলোতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস-পানির সংযোগ দেওয়ার আগেই দখল করে শুরু হয় 'বেচাকেনা'।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় অর্ধেক বাড়ি ইতিমধ্যে তিন-চার লাখ টাকায় কয়েকবার বিক্রির নামে হাতবদল হয়েছে। পুরো পুনর্বাসনকেন্দ্রটি এখন অসহায়, নিঃস্ব লোকের বদলে বিত্তশালী ও মাস্তানচক্রের হাতে চলে যাচ্ছে। হাতে অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাড়ানো হচ্ছে প্রকৃত বাস্তুহারাদের। বাইরে থেকে এসে বিত্তশালী লোকজন জমি ও বাড়ি 'কিনে' ভাড়ার ব্যবসা করছে।
পুনর্বাসনকেন্দ্রের ৩ নম্বর ব্লকের আবুল হোসেন জানান, ১ নম্বর ব্লকের শাহনূর মিয়া যে বাড়িতে বসবাস করছেন তা দেড় লাখ টাকায় 'কিনেছেন' কদবানুর কাছ থেকে। ১ নম্বর ব্লকের চুন্নু মিয়ার বাড়িটি বেশ কয়েকবার 'বিক্রি' হয়েছে। ৩ নম্বর ব্লকের সারোয়ার মিয়ার বাড়িটি আড়াই লাখ টাকায় 'কেনা' আদম আলীর কাছ থেকে। ৩ নম্বর ব্লকের সামসু মিয়ার কাছ থেকে দুই লাখ টাকায় একটি বাড়ি 'কিনেছেন' আরাফাত নেছা। ১ নম্বর ব্লকের শফিক মিয়া এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় কান্দু বেপারীর দখলি বাড়িটি 'কিনেছেন'। এ ছাড়া ১ নম্বর থেকে ৮ নম্বর ব্লক পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে ড্রেনের ওপর গড়ে উঠেছে দোকানপাট। এসব দোকানের ভিটি বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায়।
স্থানীয় লোকজন জানায়, যে যেভাবে পেরেছে জমি দখলে নিয়েছে। কেউ ১০১০ ফুট জমি, কেউ ১০০১০০ ফুট জমি দখলে নিয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ বলেন, দোকান ভিটি 'বেচাকেনা', জমি ও বাড়ি 'বেচাকেনা' এখানকার বড় ব্যবসা। দত্তপাড়া পুনর্বাসনকেন্দ্রে আট ব্লকের মধ্যে ১, ২, ৩ নম্বর ব্লকে সরকারি বাড়ি তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট ব্লকগুলোয় যে যেভাবে পেরেছে জমি ভোগদখল করে 'বিক্রি' করছে। পুনর্বাসনকেন্দ্রে বর্তমানে যেসব দরিদ্র লোক বসবাস করছে তাদের বেশির ভাগই ভাড়াটে। ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় এখানে ভাড়া পাওয়া যায়। একটি বাড়িতে ভাড়া থাকা পোশাককর্মী জরিনা বেগম বলেন, কম ভাড়ায় থাকা যায় বলে অনেক ভিক্ষুক, রিকশা-ভ্যানচালক ও মাটি কাটার শ্রমিক এখানে ভাড়া থাকেন।
পুনর্বাসনকেন্দ্রের বাসিন্দা ফাতেমা বেগম বলেন, সরকার যে বাড়িগুলো তৈরি করেছিল তা এখন অনেকেই ভেঙে নিজের প্রয়োজন মতো বড় করে নিচ্ছে। কেউ একতলা ভেঙে দোতলা করেছে। কেউ রান্নাঘর ভেঙে আরো বড় ঘর বানিয়েছে। অনেকে সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে।
সংশ্লিষ্ট পৌর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মজিবুর রহমান বলেন, পুনর্বাসনকেন্দ্রে সরকারি জমি ও বাড়ি অবাধে বিক্রি হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু এই বেচাকেনা বন্ধের কোনো এখতিয়ার পৌরসভার নেই। পৌরসভার কাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করা।
পুনর্বাসনকেন্দ্রে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অফিস ঘরে এখন কোনো কার্যক্রম না থাকায় নিরাপত্তারক্ষী আবু সাঈদ তাতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ওয়াহিদ আজহারের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ঢাকা বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ হোসেন বলেন, 'আমি এখন ব্যস্ত। কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। এ জন্য সময়ের দরকার।'

No comments

Powered by Blogger.