অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারে সার্ক নেতাদের মতৈক্য : ১৯ দফা আদ্দু ঘোষণা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত by বশীর আহমেদ,

সার্কভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সাফটার পূর্ণ বাস্তবায়ন, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ, সন্ত্রাস দমন, সমন্বিত শিক্ষাবিস্তার এবং গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোসহ ১৯ দফা আদ্দু ঘোষণার মাধ্যমে গতকাল শেষ হলো সপ্তদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে চূড়ান্ত করা এই ঘোষণাপত্র শীর্ষ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়েছে।


দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে সার্ককে একটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্লাটফরম হিসেবে গড়ে তুলতে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার যে অঙ্গীকার সার্ক নেতারা এবারের সম্মেলনে করেছেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে ঘোষণাপত্রে। তবে অনেকটা অপ্রত্যাশি-তভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সার্ক দেশগুলোর পক্ষ থেকে জোরালো কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি এই ঘোষণাপত্রে।
উনিশ দফার এই ঘোষণায় সাফটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য মিনিস্টিরিয়াল কাউন্সিলকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা কমিয়ে আনার পাশাপাশি অশুল্ক বাধা দূর, পণ্যের মানের স্বীকৃতিদান এবং
কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করার কথা বলা হয়েছে। পুঁজির ব্যাপক প্রবাহ এবং দীর্ঘমেয়াদি আঞ্চলিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে একটি প্রস্তাবনা তৈরির জন্য সার্ক অর্থমন্ত্রীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে আঞ্চলিক রেলওয়ে চুক্তি সম্পন্ন করার পাশাপাশি সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আগামী বৈঠকের আগে মোটরযান চুক্তির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের মধ্যে কন্টেইনারবাহী ট্রেনের ট্রায়াল রান বা পরীক্ষামূলক চালনা যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ভারত মহাসাগরে কার্গো এবং যাত্রীবাহী ফেরি সার্ভিস চালুর লক্ষ্যে এর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলতি বছরে যাতে শেষ হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য সার্ক মহাসচিবকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে থিম্পু ঘোষণা সময়মত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে ঘোষণাপত্রে। এর বাইরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার ব্যাপারে আর কিছুই বলা হয়নি।
জ্বালানি খাতে সহযোগিতা-বিষয়ক আন্তঃসরকার ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সম্পন্ন করার পাশাপাশি আঞ্চলিক জ্বালানি বিনিময় ধারণার বিষয়টি যাচাই করে দেখতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ঘোষণাপত্রে। এছাড়া সার্ক মার্কেট ফর ইলেকট্রিসিটি গড়ে তোলার জন্য কর্মতত্পরতা চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
সার্ক ফুড ব্যাংক চালুর ক্ষেত্রে জড়িত যেসব বিষয় রয়েছে, তা সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের পরবর্তী বৈঠকের আগেই শেষ করার কথা বলা হয়েছে আদ্দু ঘোষণায়। বাণিজ্য এবং পর্যটনকে এগিয়ে নিতে ২০১২ সালে মালদ্বীপে সার্ক বাণিজ্য মেলার পাশাপাশি সার্ক পর্যটন মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এর সঙ্গে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে ঘোষণাপত্রে।
সন্ত্রাস দমন এবং এর সঙ্গে যুক্ত অবৈধ মাদক ও ছোট অস্ত্র পাচার প্রতিরোধে আঞ্চলিক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি প্রস্তাবিত ইউএন কমপ্রিহেনসিভ কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল টেরোরিজম এবং সার্ক কনভেনশন অন মিউচুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স ইন ক্রিমিনাল ম্যাটারস অনুস্বাক্ষরের কথা বলা হয়েছে ঘোষণাপত্রে। এই অঞ্চলের সমুদ্রপথে দস্যুবৃত্তি প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি নতুন ইস্যু হিসেবে স্থান পেয়েছে ঘোষণাপত্রে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী-পুরুষের সমতা বিধান করার জন্য আন্তঃসরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে একটি আঞ্চলিক মেকানিজম গড়ে তোলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আগামী সম্মেলনে নারী-শিশু পাচার রোধসংক্রান্ত সার্ক আঞ্চলিক কনভেনশন গ্রহণের কাজ চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত্ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে একটি ‘ভিশন স্টেটমেন্ট’ তৈরির পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়া অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ার লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে সাউথ এশিয়া ফোরামকে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শিক্ষার মান উন্নয়নে সার্ক দেশগুলোর একাডেমিক ও পেশাগত ডিগ্রিকে পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং এর সমতা বিধানের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং থিংক ট্যাংকের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপনের কথা বলা হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে।
২০১২ সালে কাউন্সিল অব মিনিস্টারসের আগে সার্ক পর্যবেক্ষক দেশগুলোর ভূমিকা এবং ডায়ালগ পার্টনারশিপের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। সার্ক দেশগুলোর গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণমাধ্যম দিবস পালনের কথা বলা হয়েছে। গণমাধ্যম বিষয়ে একটি আঞ্চলিক সম্মেলনের মাধ্যমে এই মিডিয়া দিবস পালনের তারিখ চূড়ান্ত করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া এবারের ঘোষণাপত্রে আন্তঃসরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সার্ক সচিবালয় ও আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোকে শক্তিশালী এবং এ অঞ্চলের মানুষের জন্য নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সার্কের অধীনে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.