ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে প্রেমিক রেহান ওড়নার ফাঁস দিয়ে হত্যা করি আদৃতাকে

"মডেলিং করতে গিয়েই আদৃতার সঙ্গে আমার পরিচয়। অতঃপর ঘনিষ্ঠতা। ৬ মাস ধরে প্রেম করলেও পুরো সময়টাই সে আমাকে প্রচণ্ড জ্বালাতন করেছে। যেদিন আদৃতাকে হত্যা করা হয়, সেদিনও 'জেনেসিস ভিউ' অফিসের চিলেকোঠায় সে আমার ওপর 'চড়াও' হয়। দু'জনের হাতাহাতির এক পর্যায়ে আমি আদৃতাকে দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা দিলে সে মাথায় আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। তখন আমি তাকে গলায় ওড়নার ফাঁস দিয়ে হত্যা করি। এটা ওর প্রতি ক্ষোভ থেকেই করেছি।" এভাবেই র‌্যাম্প মডেল তাহিয়া তাবাসসুম আদৃতা হত্যার বর্ণনা দিলেন তার প্রেমিক আশিস কর্মকার ওরফে রেহান ওরফে বিদ্যুৎ।


বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ রেহানকে গ্রেফতার করে। ২৩ বছর বয়সী রেহান নিজেও র‌্যাম্প মডেলিং করেন। তিনি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র। গতকাল শুক্রবার দুপুরে রেহানকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে হাজির করা হয়। গত ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে অবস্থিত জেনেসিস ভিউ নামে একটি প্রডাকশন হাউসের চিলেকোঠায় আদৃতাকে হত্যা করা হয়। পরের দিন রাতে সেখান থেকে আদৃতার লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই সময় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ রেহানকে আটক করলেও রহস্যজনক কারণে তাকে ছেড়ে দেয়।
হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে রেহান জানান, ২৯ অক্টোবর রাতে তারা দু'জন ধানমণ্ডিতে এক বন্ধুর বাসায় রাত যাপন করেন। পরের দিন সকালে আদৃতা বাসায় চলে যায়। দুপুরের দিকে আদৃতা আবার ঢাবি ক্যাম্পাসে আসেন। দু'জন মিলে বিকেল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আড্ডা দিয়ে রায়েরবাজারে ইয়াবা কিনতে যান। পরে তিনটি ইয়াবা নিয়ে দু'জন তাজমহল রোডে জেনেসিস ভিউ অফিসে যান। অফিসটি তালাবদ্ধ থাকায় সিঁড়িতে বসে ইয়াবা সেবন করেন দু'জনে। এ সময় আদৃতার সঙ্গে তার খুনসুটি শুরু হয়। তাকে জামার কলার চেপে থাপ্পড় দেন আদৃতা। ক্ষোভে আদৃতাকে দেয়ালে ধাক্কা দিলে মাথায় আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে যান। এ সময় তাকে গলায় ওড়নায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানান রেহান।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রেহান জানান, আদৃতা মারা যাওয়ার পর তিনি হত্যাকাণ্ডটি গণধর্ষণ হিসেবে দেখানোর জন্য তার শরীরের পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন। মেঝেতে আঘাত করে মুখমণ্ডল থেঁতলে দেন। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানগুলোতেও আঘাত করেন। ওড়না দিয়ে দেয়াল ও সিঁড়ি মুছে দেন। পরে আলামত নষ্ট করতে তার মোবাইল ফোন সেট ও ওড়না ডাস্টবিনে ফেলে দেন। এমন নৃশংস বর্ণনার সময় রেহানকে সামান্য বিচলিত হতে দেখা যায়নি।
রেহান জানান, নিজের হাতে মানুষ হত্যা করার কারণে তিনি অনুতপ্ত। তবে আদৃতাকে হত্যার ঘটনায় তিনি অনুতপ্ত বা বিচলিত নন। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিচয়ের পর ঘনিষ্ঠ হলে তিনি আদৃতার উগ্রতা বুঝতে পারেন। আদৃতা ইয়াবা সেবন করতেন। তার মাধ্যমে নিজেও ইয়াবা সেবন শুরু করেন। আদৃতা তাকে নানাভাবে বিচলিত করেছেন। মানসিক নির্যাতন করেছেন। দু'জনের বিয়ে না হলেও বন্ধুদের কাছে বলেছেন তাকে আমি বিয়ে করেছি। এক পর্যায়ে জানতে পারেন, এর আগে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় আদৃতার বিয়ে হয়েছিল। তিনি মানসিকভাবে উগ্র। তার চিকিৎসাও হয়েছে। এসব কারণে বারবার তাকে ত্যাগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে রাগের মাথায় আদৃতাকে হত্যা করা হলেও তা পরিকল্পিত ছিল না বলে দাবি রেহানের।
রেহানকে গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ২০১০ সাল থেকে রেহানের সঙ্গে আদৃতার পরিচয়। তবে ৬ মাস ধরে তাদের ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। এরপর থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন বাসায় রাতযাপন করতেন। তবে আদৃতার লাশ উদ্ধারের পর থেকেই তারা ছায়া তদন্ত শুরু করেন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিবি নিশ্চিত হয়, আদৃতাকে খুনের সময় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে রেহানের মোবাইল ফোন তাজমহল রোডে সচল ছিল। এর সূত্র ধরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রেহান আদৃতাকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তবে 'মেধাবী' রেহান বাঁচার জন্য হত্যাকাণ্ডের পর নিজের মোবাইল থেকে আদৃতার মোবাইলে একাধিক রোমান্টিক মেসেজ দেন। মেসেজে জানতে চান, আদৃতা কোথায়, তার ফোন বন্ধ কেন? আদৃতাকে হত্যার পর রেহান ঢাবির জগন্নাথ হলে অবস্থান করেন। নিজেকে কেউ যাতে সন্দেহ করতে না পারে সে জন্য পালিয়ে না গিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। এসবই ছিল তার কৌশল।
ডিবি কর্মকর্তা তৌহিদ আরও বলেন, রেহানকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল কি-না বা এর সঙ্গে আর কারও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি-না তা জানার চেষ্টা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.