ঐতিহ্য-তাঁতে দিনবদল মণিপুরিদের by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন,

নানা প্রতিকূলতায় ছোট-বড় জনগোষ্ঠীগুলো হারাতে বসেছে তাদের ঐতিহ্যের শেকড়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মণিপুরিরাও এর ব্যতিক্রম নয়। আশার কথা হলো, তাঁতশিল্পীরা এখনো হাল ছাড়েননি। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তাঁরা ধরে রেখেছেন নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার চিরন্তন গৌরবটুকু। হস্তশিল্পটি আপন মহিমায় আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।সময়ের পরিবর্তনে পাল্টে যায় অনেক কিছুই। পাল্টে যায় রুচি, চাহিদাও। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে চাহিদার পার্থক্য সূচিত হলেও অধিকাংশ পরিবার সময়ের সঙ্গে হেঁটেছে। এভাবেই তারা ধরে রেখেছে নিজেদের বনেদি আত্মপরিচয়।


একই সঙ্গে আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরিবার ও দেশের উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এভাবে তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের একটি বিশেষ অবস্থান। তাঁতশিল্পের কল্যাণে মণিপুরি সম্প্রদায়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেকারত্বের হার এখন অনেকটাই কম। পরিবারের প্রায় সবাই উপার্জনক্ষম।
মণিপুরিরা নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র নিজেরাই তৈরি করে থাকে। মণিপুরি মেয়েরা সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবে পরিবেশবান্ধব কোমর-তাঁতের মাধ্যমে বিভিন্ন রকম কাপড় তৈরি করে। দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছেও মণিপুরি তাঁতযন্ত্রে বোনা কাপড়ের বিশেষ কদর রয়েছে।
বর্তমানে সিলেট সদর, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও সুনামগঞ্জের ছাতকে মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে। গ্রামের ঘরে ঘরে মণিপুরি নারীরা বাঁশ আর রঙিন সুতার শৈল্পিক স্পর্শে তৈরি করে থাকেন নান্দনিক হস্তশিল্প। সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁতযন্ত্রে নিজস্ব ধারণা থেকে তাঁরা তৈরি করেন বিভিন্ন রকম কাপড়।
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের বাঘবাড়ি, গোকুলসিংহেরগাঁও,
পাঞ্জিগড়সহ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সুদখোর মহাজনদের দৌরাত্ম্য অনেকটা কমলেও এখনো নির্মূল হয়নি।
অবশ্য তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের অধীনে এক হাজার ২১৩ জন তাঁতিকে এক হাজার ৫৬১টি তাঁতের বিপরীতে মোট এক কোটি ৫৬ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের জনসংযোগ কর্মকর্তা মানিক মিয়া কালের কণ্ঠকে জানান, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে স্বনির্ভর হতে তাঁরা তাঁতিদের সহায়তা দেন। তাঁদের স্থানীয় তাঁত বোর্ড সমিতির সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। তিনি আরো জানান, মণিপুরি কাপড় বিদেশেও প্রচুর রপ্তানি হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা তাঁতিদের তাঁরা সমিতির মাধ্যমে সংগঠিত করে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করেন। সমিতির প্রতিনিধিদের সুপারিশক্রমে তাঁতিদের ঋণও দেওয়া হয়।
'ইমা মণিপুরি হস্তশিল্পের' স্বত্বাধিকারী রথিন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ঈদ, পূজা আর শীতের মৌসুমে মণিপুরি কাপড়ের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তাঁতশিল্প নিয়ে শুরুতে নানা প্রতিকূলতা থাকলেও সময়ের ব্যবধানে তা অনেকাংশই কমে এসেছে। আগে তাঁতিদের কাপড় বাজারজাতকরণের সমস্যা ছিল। দোকান ছিল হাতেগোনা দু-একটা। তাতেও আবার বাধা ছিল মহাজনি প্রথায়। এর ফলে কারিগররা পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতেন না। এখন কমলগঞ্জে বেশকিছু দোকান হয়েছে। তৈরি হয়েছে প্রতিযোগিতা। ফলে তাঁতশিল্পীরা এখন পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন।
হস্তশিল্পী মিনতি সিনহা বুনন কৌশল সম্পর্কে বলেন, 'আমরা যে তাঁত ব্যবহার করি, তাকে বলা হয় কোমর-তাঁত। এই তাঁতে কাপড় বুননের আগে ধারাবাহিকভাবে বেশকিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। একটি শাড়ি বুননে সময় লেগে যায় প্রায় ৮-১০ দিন। শাড়ি বেশি লম্বা হওয়ায় একজনের পক্ষে নকশা ও বুনন করা সম্ভব হয় না। অন্যান্য বস্ত্র এককভাবেই বুনন করা হয়ে থাকে। মণিপুরি কাপড়ের মধ্যে থ্রি-পিস, শাড়ি ও চাদরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।'
শ্রীমঙ্গল রামনগর শর্মিলা হ্যান্ডিক্রাফটের স্বত্বাধিকারী রামানন্দ সিনহা বলেন, 'কমলগঞ্জ ছাড়াও শ্রীমঙ্গলের রামনগর মণিপুরিপাড়া ও টিকরিয়ায় মণিপুরি তাঁত রয়েছে। মণিপুরি কাপড়ের মধ্যে রয়েছে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, ফতুয়া, বিছানার চাদর, শাল, ভ্যানেটি ব্যাগ, পার্স ব্যাগ, রুমাল, কলেজ ব্যাগ, ওড়না প্রভৃতি। থ্রি-পিস ৪৫০ থেকে ৬০০, শাড়ি ৬০০ থেকে ১৮০০, পাঞ্জাবি ৩৫০ থেকে ১০০০ টাকা। বড়দের ফতুয়া ২৫০ থেকে ৪৫০, ছোটদের ফতুয়া ১০০ থেকে ২৫০, গায়ের চাদর ৩৫০ থেকে ১৭০০ টাকায় বিক্রি হয়। দামটা মূলত নির্ভর করে সুতার দামের ওপর।'
থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং মণিপুরি ললিতকলা একাডেমীর নাট্য-প্রশিক্ষক শুভাশীষ সিনহা বলেন, 'মণিপুরি তাঁত আর তাঁতিদের নানা সংকট তুলে ধরে আমরা দুটি মঞ্চনাটক প্রযোজনা করেছি। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় কিভাবে মণিপুরি তাঁতিরা ঠকবাজির শিকার হচ্ছেন, কিভাবে মণিপুরি তাঁত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে_এর সবই উঠে এসেছে এ দুটি নাটকে।'
 

No comments

Powered by Blogger.