জ্বালানি নিরাপত্তা ও রনো ভাইয়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে by ড. তারেক শামসুর রেহমান

বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম গত ১১ অক্টোবর। সেখানে সঙ্গত কারণেই গ্যাস ও কয়লা নিয়ে উন্মুক্ত সংলাপের কথাটি এসেছে। ওই লেখায় কোথাও রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনোর প্রসঙ্গটা আসলেও, রনো ভাই তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গত ১৮ অক্টোবর তার কলামে। রনো ভাই আমার প্রিয় মানুষদের একজন। বাংলাদেশের যে ক’জন ব্যক্তি রাজনীতিতে এখনও তার নীতি বিসর্জন দেননি, রনো ভাই তাদের মাঝে একজন।

রনো ভাই রাজনীতি করলেও, জাতীয় রাজনীতি নিয়ে লিখছেন, আমার ভলো লাগা সেখানেই। আরও কৃতজ্ঞ আমি তার কাছে যে, আমার সম্পাদিত দুটি গ্রন্থে (বাংলাদেশ : রাজনীতির চার দশক ও বাংলাদেশ : রাজনীতির ২৫ বছর) তিনি দুটি প্রবন্ব্দ দিয়েছেন। অনেকটা দাবি করে তার কাছ থেকে প্রবন্ব্দ দুটি আমি আদায় করেছি। আমার পরিবারের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠ। আমার প্রয়াত খালা কামরুন নাহার লাইলী ও খালু আনোয়ার জাহিদেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। সে কথা স্বীকার করতেও এতটুকু কার্পণ্য তার নেই। ছাত্রাবস্থায় শত শত তরুণের মতো আমিও বাম রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। মওলানা ভাসানী ছিলেন আমার আদর্শ। সে কারণে এ দেশের অনেক বাম রাজনীতিকের মতো রনো ভাইও আমার পরিচিত। ছাত্র রাজনীতি না করার কারণে তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, এটা আমি দাবি করব না। রনো ভাই রাজনীতি করেন। না করলে হয়তো আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন। আমি পড়াশোনাটাই বেছে নিয়েছি। রাজনীতি বুঝি না বলেই রাজনীতি করিনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমার চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন এসেছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটাই স্বাভাবিক। এক সময়ের মাও জে ডং-এর চীন, আর আজকের স্ল জিন তাও-এর চীন এক নয়। আমি আশির দশকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখে এসে লিখেছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবে না। কেন থাকবে না, তাও লিখেছিলাম। যুগের এটাই চাহিদা। সংস্কার আনতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধিয়ে বসেছিলেন গর্বাচেভ। আসলে আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আসে। সমাজতন্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। কেউ সেটা মানছেন, কেউ মানছেন না। রনো ভাই এখনও তার আদর্শ থেকে সরে যাননি। কিন্তু অনেকে গেছেন। মেনন ভাই আমাদের আদর্শ ছিলেন এক সময়। সেই মেনন ভাইদের বর্তমান অবস্থানও অনেকে পছন্দ করেন না। করেননি রনো ভাইও। রনো ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এ কারণেই অনেক বেশি এবং এটা থাকবেও। দুঃখ লাগে সেই রনো ভাই যখন আমাকে ভুল বোঝেন। শুধু বিনীতভাবে বলতে চাই, রনো ভাই হয়তো আমার লেখার মূল স্পিরিটটা বুঝতে পারেননি। আমার লেখার মূল স্পিরিট ছিল বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা। একটা ‘জ্বালানি নিরাপত্তা’ ঝুঁকিতে আমরা রয়েছি। এটা বোঝাতে গিয়ে আমি সমুদ্রসীমায় গ্যাস উত্তোলনের পক্ষে কথা বলেছি ও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে কথা বলেছি। আমি গ্যাস বা খনি বিশেষজ্ঞ নই। আমি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি। ইদানীং কাজ করছি------- নিয়ে। অর্থাৎ পানি, পরিবেশ, জ্বালানি, খাদ্য, দারিদ্র্য ইত্যাদি যে রাষ্ট্রকে বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে—এ বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করছি এবং শরীর সুস্থ থাকলে ফেব্রুয়ারিতে একটি বই উপহার দিতে পারব আশা করছি। তাই সঙ্গত কারণেই জাতীয় কমিটি যখন গ্যাস ও কয়লা নিয়ে আন্দোলন করছে, তখন তার প্রতি আমার দৃষ্টি থাকবেই। এখানে জাতীয় কমিটির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার সঙ্গে আমার চিন্তার মিল নাও থাকতে পারে। তবে এক জায়গায় মিল রয়েছে, তা হচ্ছে আমি গ্যাস রফতানির বিপক্ষে। আমার যুক্তি ছিল, যেহেতু ২০১১ অথবা ২০১২ সালে গ্যাস ফুরিয়ে যাবে, তখন সমুদ্রের গ্যাসই আমাদের ভরসা, যদিও তা পেতে পেতে আমাদের আরও ৫ থেকে ৬ বছর লেগে যাবে। এখন বিদেশি কোম্পানি ছাড়া বাপেক্সের সেই প্রযুক্তি ও অর্থ কি রয়েছে, যা দিয়ে তারা গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ব্দান করতে পারে? যে কোনো অনুসন্ব্দান ও খনন কাজে সাধারণত ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়ে থাকে। খনন কাজে সর্বোচ্চ ব্যয় ৪৫ কোটি টাকা। গভীর সমুদ্রে এই ব্যয় আরও বেশি। এত বিপুল অর্থ ও কারিগরি জ্ঞান বাপেক্সের নেই। সুতরাং ভরসা বিদেশিরাই। এখানে পিএসসির ব্যাপারে আপত্তি উঠেছে। সেটা আমিও বলেছি। রফতানি নিষিদ্ধ করাকে প্রাধান্য করে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এক্ষেত্রে যদি ‘আন্দোলন’ হয়, তাহলে একটি ভুল বার্তা বিদেশে পৌঁছে যেতে পারে এবং বিদেশি তেল ও গ্যাস অনুসন্ব্দানকারীরা বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। আর এমনটাই যদি হয়, তাহলে লাভবান হবে কারা? নিশ্চয়ই ইউনিকলের মতো বস্লজাতিক কোম্পানিগুলো, যারা তুর্কমেনিস্তানের গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিয়ে আসছে। এজন্য আমি আইপিআই ------- প্রজেক্টের কথা উল্লেখ করেছিলাম। রনো ভাই এ প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলায়, আমি অবাকই হয়েছি। পাঠকদের জানিয়ে রাখি ইউনিকল এক সময় বাংলাদেশের গ্যাস ভারতে রফতানির উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়াই ভারত সরকারের সঙ্গে পাইপ লাইনে গ্যাস রফতানিবিষয়ক একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিল। তারা যুক্তি দেখিয়েছিল বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আগামী ২০ বছর ভারতে রফতানি করে প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে। সেই ইউনিকল টাপিই প্রজেক্টে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তারা তালেবানদের রাজি করিয়ে, খুশি করিয়ে গ্যাস নিয়ে আসছে নয়াদিল্লি পর্যন্ত। এখন বাংলাদেশে যদি গ্যাস না থাকে, যদি গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস তুলতে না পারি, তাহলে গ্যাসের জন্য ইউনিকলের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প আছে কি? ইউনিকল তো ভারতের ভেতরেই গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ করছে। বাংলাদেশকে শুধু যুক্ত করা মাত্র! এজন্যই আমি গ্যাস রফতানির পক্ষে নই, কিন্তু সাগর থেকে গ্যাস উত্তোলনের পক্ষে। আমাদের গ্যাসের বিকল্প কয়লা। আমি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে, জাতীয় কমিটি এর বিপক্ষে, এটা হতেই পারে। আমার যুক্তি নিম্নরূপ—
১. উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে ৯০ ভাগ, আর ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে ১০ ভাগ (কারও কারও মতে ২০ ভাগ)। বড় পুকুরিয়াতে আমরা ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুলছি। এখন ফুলবাড়ী, জামালগঞ্জ, দিঘীপাড়া ও খালাসপীরে যে কয়লা মজুত রয়েছে, তার ১০ ভাগ যদি উত্তোলন করি, তাহলে ২৫০ কোটি মেট্রিক টনের প্রায় পুরোটাই তো মাটির নিচে রয়ে গেল। প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে তো আমরা লাভবান হলাম না। ২. উন্মুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করলে কিছু লোক ভিটেবাড়ি হারাবে, উদ্বাস্তু হবে, এটা সত্য। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের যদি পুনর্বাসন করা যায়, যদি তাদের জন্য বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন সৃষ্টি করা যায়, সেটা কি নেহায়েত খারাপ? ৩. উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ব্যবহার উপযোগী কিছু সহ-সম্পদ (চীনামাটি, কাচ, বালি, নুড়ি পাথর) পাওয়া যায়। তাতে তো আমাদের লাভ; ৪. ফুলবাড়ীর কয়লা দিয়ে ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করার কথা। প্রথম পর্যায়ে ৫০০ মেগাওয়াট ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫০০ মেগাওয়াট। ৫০০ মেগাওয়াটের জন্য প্রয়োজন ১.৫ মিলিয়ন টন কয়লা (বছরে)। যা কিনা ফুলবাড়ীতে উত্পাদিত কয়লার এক দশমাংশ; ৫. ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প চালু করা সম্ভব হলে প্রতি বছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; ৬. দেশে আবিষ্কৃত ৫টি কয়লা খনিতে যে কয়লা রয়েছে তা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য যা কিনা আমাদের ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে। যদিও সবটা হয়তো তোলা যাবে না। কিন্তু উন্মুত প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিজার্ভের অনেকটাই তোলা সম্ভব; ৭. ভারতে উত্পাদিত কয়লার শতকরা ৮১ ভাগ আসে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে; ৮. বড়পুকুরিয়াতে ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে মাত্র ১০ ভাগ কয়লা তোলাও সম্ভব হবে না। আমি কোনো বস্লজাতিক কোম্পানির পক্ষে কথা বলছি না। বলছি বাস্তবতা ও তথ্যউপাত্ত যাচাই করে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয় কয়লা থেকে। বর্তমানে বিশ্বে কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ হচ্ছে অসেল্ট্রলিয়া ৭৯ শতাংশ, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফিদ্ধকা ৯২, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ ও বাংলাদেশ ৫ শতাংশ। সুতরাং যেখানে আমরা বড় ধরনের ‘এনার্জি ট্রাপ’ বা ‘জ্বালানি ফাঁদ’-এ পড়তে যাচ্ছি, সেখানে কয়লা ছাড়া কোনো বিকল্প আপাতত নেই এবং যা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হলে আমরা আমাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারব। এখানে সমস্যা হচ্ছে আমাদের জ্বালানি নীতি এখনও প্রণীত হয়নি। অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারি কমিটি ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে যে রিপোর্ট দিয়েছিল, তাতে রফতানির সুযোগ না রেখে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কথা বলেছিল। এখানে ২৫ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রয়েলটির পরিমাণ বাড়িয়ে ২০ থেকে ৩০ ভাগ করা ও খনির মালিকানা ১০০ ভাগ রাষ্ট্রের কাছে রেখে জ্বালানি নীতিকে আরও সমৃদ্ধ করা যায়। উল্লেখ্য, ভারতীয় (ড. অজয় কুমার ঘোষ) ও বাংলাদেশী ভূতত্ত্ববিদরা (ড. ইউনুস আকন) উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আহরণের কথাই বলেছেন। অবশ্যই আমরা সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি কিংবা পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার বাড়াব। কিন্তু জ্বালানির যে বিপুল চাহিদা, তাতে এই তিনশক্তি খুব একটা অবদান রাখতে পারবে না। রনো ভাই নিশ্চয়ই জন গ্রে’র একটি প্রবন্ব্দ পড়েছেন (দি গার্ডিয়ান, মার্চ ২০০৮, অ্যাপোকবিলিয়াটিক রেলিজিওন অ্যান্ড দ্য ডেথ অব ইউটোপিয়া)। গ্রে বলেছিলেন, একুশ শতকে যুদ্ধ হবে জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তেল ও গ্যাস যাদের নিয়ন্ত্রণে, তারাই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করবে। আমি তাই বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। বিদ্যুত্ না দিতে পারলে জনঅসন্তোষ বাড়বে। গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কটে ইতোমধ্যে নতুন শিল্প স্থাপন বন্ব্দ হয়ে গেছে। যেখানে দৈনিক চাহিদা ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস, সেখানে উত্পাদন হচ্ছে প্রতিদিন ১৯০ থেকে ১৯৫ কোটি ঘনফুট (সমকাল ২৬ সেপ্টেম্বর, ০৯) গ্যাস। এই চাহিদা আমরা পূরণ করব কীভাবে? তাহলে কি নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপিত হবে না? আমরা কি নির্ভরশীল থাকব পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের উপর? রনো ভাই পণ্ডিত রাজনীতিবিদ। জ্বালানি সঙ্কট আমরা কীভাবে মেটাব এ বিষয়টি নিয়ে লিখলে আমি খুশি হতাম।
রনো ভাই তার প্রবন্ব্দে আমার লেখার ব্যাপারে যেসব মন্তব্য করেছেন, আমার ধারণা তিনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। প্রথম কথা হচ্ছে আমি জাতীয় কমিটির আন্দোলনের বিপক্ষে নই, বরং কিছুটা হলেও পক্ষে। আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের বন্ব্দু আনু পুলিশের পিটুনি খেল, তখন আমি পত্রিকায় কলাম ধরেছিলাম। প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি কারও পক্ষে কথা বলি না। আমার বিবেচনায় যা সত্য মনে হয়েছে, তা বলি ও লিখি। তার জন্য সরকারের পক্ষের লোকেরা আমাকে সমালোচনা করেন, আবার বিরোধীপক্ষও মনে করে আমি ‘বিক্রি’ হয়ে গেছি। এটাই দলবাজি। আমি এই দলবাজির পক্ষে নই। আমি যেসব বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান আহরণ করেছি, কেউ যদি চায়, তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে আমি সব সময় প্রস্তুত। দ্বিতীয় কথা, গ্যাস উত্তোলন বা রফতানি (?) একটি জাতীয় ইস্যু। ঠিক তেমনি আমার বিবেচনায় টিপাইমুখ, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিও জাতীয় ইস্যু, যা কিনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। তাই আমি বলতে চেয়েছি প্রতিটি জাতীয় ইস্যু একত্রিত করে এক ব্যানারে আন্দোলন করা যায়। তাতে করে আরও অনেক লোককে আন্দোলনে শরিক করানো সম্ভব। ব্যক্তির একটি বক্তব্য বা প্রবন্ব্দের (টিপাইমুখ) চেয়ে সম্মিলিত বলা অনেক কার্যকর। গ্যাসকে প্রাধান্য দিলে মনে হতে পারে টিপাইমুখ গৌণ। আমার বিবেচনায় দুটিই মুখ্য। তৃতীয় কথা, প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা বলেছি এজন্য যে, এখনও ভোটারদের প্রায় ৩৪ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপি। তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলে জাতীয় কমিটি কি ‘অচ্ছুত্’ হয়ে যাবে? জাতীয় কমিটি তো কোনো দল নয়। চতুর্থ কথা, আমি কখনও বলিনি জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ ‘আন্দোলনের জন্য বিদেশে গেছেন ও টাকা এনেছেন’। এ কথাটা কেউ কেউ বলেন, আমি শুধু তা তুলে ধরেছি। এটা তো সত্য, আনু একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন এবং এই গ্যাস রফতানির প্রসঙ্গটি সামনে রেখেই। এখন কাদের আমন্ত্রণে গেছেন, আমরা জানি না। কিন্তু রনো ভাই নিজেও জানেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, নব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের স্বার্থে ‘একাধিক ফদ্ধন্ট’ ওপেন করে। এনজিওর ছদ্মাবরণে তারা বুদ্ধিজীবীদের কেনে। ইরানে মোসাদ্দেকের সময় কী হয়েছিল, বলিভিয়ায় কী হয়েছিল, এসব রনো ভাই জানেন। ইউনিকল তো তাদের স্বার্থের প্রয়োজনে তালেবান নেতাদের পর্যন্ত ওয়াশিংটন নিয়ে গিয়েছিল। আমি আবারো বলি আনু বা রনোরা আমাদের সমাজের বিবেক। আমি যা পারিনি আনু, রনো, শহিদুল্লাহরা তা করছেন। কিন্তু তারা কেউ যদি কারো ‘ফাঁদে’ পরেন, আমরা কষ্ট পাব। পঞ্চম কথা, বর্তমান পিএসসিকে আমি সমর্থন করিনি। অবশ্যই আমি গ্যাস রফতানির বিপক্ষে। আমার কথায়, যদি গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে পেট্রোবাংলা অথবা বাংলাদেশী ‘কনসোর্টিয়াম’ এই গ্যাস কিনবে ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করবে। এখানে রনো ভাই আমাকে ভুল বুঝেছেন। ষষ্ঠ কথা, রনো ভাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের পক্ষে। হতেই পারে। আমার অবস্থান আমি জানিয়েছি। সেখানে যে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে কিন্তু রনো ভাই কিছু বলেননি। সপ্তম কথা, ‘সরকারের একটি অংশের নির্দেশে’ বলে আমার প্রবন্ব্দে একটি বাক্য আছে। এটি ‘হাইপোথিটিকাল’— কেউ একজন বলতে পারেন, আমি এ কথাটাই বোঝাতে চেয়েছি। আর আমি কোনো বিদেশি কোম্পানির পক্ষে ওকালতিও করিনি। যে কারণে রনো ভাই জেনে রাখবেন, আমি আজ অব্দি কোনোদিন কোনো বিষয়ে কোনো ‘কনসালটেন্সি’ করিনি। অনেকবার বলা হয়েছে। দাতাদের শেখানো বুলি আমার হাত দিয়ে বেরুবে না। অতীতেও বের হয়নি, রনো ভাই আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি, আগামীতেও বের হবে না। এখানে একটু হলেও কষ্ট লেগেছে, যখন দেখি তিনি প্রবন্ব্দের শিরোনাম করেন ‘ড. তারেক শামসুর রেহমানের বক্তব্য নিয়ে কিছু কথা’ (১৮ অক্টোবর, ২০০৯)। এখানে ড. তারেক প্রাধান্য পেয়েছে। প্রাধান্য পায়নি বিষয়বস্তু, অর্থাত্ জ্বালানি নিরাপত্তা। পিএসসি একটা ব্যাপক আলোচিত বিষয়। সবাইকে দুটি প্রবন্ব্দ পড়ার অনুরোধ জানাই------- দুটি প্রবন্ধই ছাপা হয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে দর কষাকষি। আইওসি’র সঙ্গে আলোচনায় এই দর কষাকষিটাই আসল। আমাদের ব্যর্থতা সেখানেই। দর কষাকষিতে আমরা সব সময়ই দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারি না। তাল্লো ও কনকো ফিলিপস-এর সঙ্গে আলোচনায় দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রাখলে খুশি হব।
লেখক : রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.